আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত ধরে হেঁটে চলেছি আমি। সম্মুখ পাণে শুধু উপরে কালো মেঘের লুকোচুরি খেলার ফাঁক দিয়ে সুবিশাল নীলাকাশ। এক পাশে সাগরের নীল জল তীরে এসে ফেনায়িত ঢেউ হয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার পদ যুগল, ঠিক যেন প্রেয়সীর আলতো স্পর্শ। আর ঠিক তার বিপরীত পাশে কৃত্রিম বনায়নের সবুজের সমারোহ। এই দুইয়ের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি, সম্মুখপানে আর কেউ নেই। কানে গোঁজা হেডফোন, সেখানে বাজছে....
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
সাগরের ঢেউয়ে চেপে
নীলজল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো,
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
নোনা বালি তীর ধরে
বহু দূর বহু দূর হেটে এসেছো।
আমি কখনো যাই নি জলে
কখনো ভাসিনি নীলে
কখনো রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাংচিলে
আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নান -এ যাবে
আমাকে ও সাথে নিও
নেবে তো আমায়?
বল নেবে তো আমায়...।
চারিপাশে চেয়ে দেখি কোথাও হতে কেউ কি সত্যি আমায় কানে কানে গুণগুণ করে বলছে এই কথাগুলো? কোন সুদূরে আমার সেই প্রেয়সী, যার হাত ধরে অনন্তকাল হেঁটে যেতে পারবো এমন মেঘলা দিনে নীরব সাগর তীর ধরে, দূর হতে বহুদূর। যেথায় আমাদের স্বর্গকুটির হাতছানি দিয়ে ডাকবে আমাদের, সুখ সাগরে ডুব দিতে।
পেছন হতে ভ্রমণ সাথী হাসিব এসে কাঁধে হাত দিতে বাস্তবে ফিরে এলাম। ঈদের পর টানা এক সপ্তাহ চিটাগং হান্ট এর দ্বিতীয় দিন আমরা দুজন যাই আনোয়ারা উপজেলার আলোচিত সমুদ্র সৈকত “পারকি’র চর” ভ্রমণে। মধ্য দুপুরে আকাশে যখন কালো মেঘের ঘনঘটা, তখন আমি হাঁটছিলাম সৈকত ধরে সোজা বিপরীত দিকে। স্থানীয় এক ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম সামনে গেলে রাস্তা পাওয়া যাবে মূল সড়কে ওঠার। আধঘণ্টা হাঁটতেই বৃষ্টি নামলো, হাসিবের কাছে ছাতা দিয়ে ব্যাগের ভেতর মোবাইল, ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে আমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ধীর গতিতে ফিরতে লাগলাম পেছনে ফেলে আসা ঝাউ গাছের সারির দিকে। মিনিট দশেক অপূর্ব বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গুণগুণ করে গাইছিলাম, কেন জানি না...
দুরে তুমি দাড়িয়ে
সাগরের জলে পা ভিজিয়ে।
কাছে যেতে পারি না,
বলতে আজ পারি না...
"তুমি আমার এখনও"!
সামনে তুমি দাড়িয়ে,
কারো হাত জড়িয়ে।
হাতটা ধরতে পারি না,
কাছে টানত পারি না,
তোমার হাতে আজ অন্য কেউ।
সাগরের পাড়ে হাত ধরে
দেখছ সূর্য ডোবা মেঘে,
এখনও বৃষ্টি পড়ে তোমার মাঝে,
সেই বৃষ্টির ফোটা আমি নই।
ঝাউগাছের তলায় পৌঁছতে হাসিব বলল, ‘চলেন লাঞ্চ করে নেই’। খুঁজে পেতে ঠিক আমাদের সামনেই ঝাউগাছের সারি যেখানে শেষ, সেখানটায় বীচের তীর ঘেঁষে একটা রেস্টুরেন্ট পেয়ে ঢুকে পড়লাম উদর পূর্তির উদ্দেশ্যে। চমৎকার আয়োজন, খাবারের মানও ভালো আর দাম তুলনামূলক অনেক কম অন্যান্য টুরিস্ট স্পটের সংলগ্ন রেস্টুরেন্টগুলো চাইতে।
খাওয়া শেষ করতে করতে বৃষ্টি থেমে গেল, এবার পরিস্কার আকাশের নীচে ভেজা বালির সৈকতে ঘোরাঘুরি, ছবি তোলা। হাসিব আবার হবু ফটোগ্রাফার, তাই তার ছবি তোলা চলল, সাথে আমিও আমার ছোট্ট ক্যামেরায় কিছু তুললাম। বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা ফেরার পথ ধরলাম, সূর্যাস্ত মিস করলাম। কারণ ফিরতে হবে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে।
চট্টগ্রাম শহর হতে দুইভাবে আপনি পারকি বীচ যেতে পারেন। একটা হল বহদ্দারহাট টার্মিনাল হতে আনোয়ারা হয়ে পারকি যাওয়ার বাস আছে, আপনি কাফকো সেন্টার স্টপেজে নেমে সিএনজী করে বীচে চলে আসতে পারেন। বাস ভাড়া ৫০-৬০ টাকা, সিএনজী ভাড়া ১০০ টাকা। যাওয়ার সময় শেয়ারে সিএনজী পেতে পারেন, ফেরার সময় পুরোটাই আপনাকে রিজার্ভ করে আসতে হবে। আরেকটা পথ হলে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে ১৫ নাম্বার ঘাট (নেভাল বীচ যাওয়ার ঠিক আগে) হতে বোটে করে নৌকা পার হয়ে সিএনজী রিজার্ভ করে সরাসরি পারকি বীচ। এক্ষেত্রে সিএনজী ভাড়া যাওয়া আসা রিজার্ভ করে যাওয়া ভালো, ভাড়া নিবে ৫০০-৬০০ টাকা।
বীচ এলাকা আসলে ঠিকমত সংরক্ষণ না করলে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে, পারকি বীচ এর ক্ষেত্রেও এমনটা হওয়া শুরু হয়েছে। পাকা ইটের ঝিনুক মার্কেট, রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠছে। রয়েছে বীচে জুয়াড়িদের আনাগোনা। এখনই সরকার নজর না দিলে কক্সবাজার, পতেঙ্গা, সেন্ট মার্টিনের মত নষ্ট হয়ে যাবে এই বীচটিও অতি দ্রুতই।