‘ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই’ সিরিজে পরবর্তী যে বইটি সিলেক্ট করেছিলাম তা ছিল বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সমাদৃত সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’। এই বই পড়তে গিয়ে মনে হল শুধু পাঠানদের নিয়ে লেখকের ভাবনা নিয়ে, বর্ণনা দিয়ে, উপলব্ধি নিয়ে একটা লেখা লিখা উচিত। আর সেই ভাবনা থেকেই এই লেখা – ‘পাঠাননামা’।
পরে ‘দেশে বিদেশে’ নিয়ে লেখা যাবে। আসুন দেখি ‘পাঠাননামা’।
এই বইতে শুরুতেই লেখক ট্রেনে পরিচিত হন পাঠানদের সাথে। লেখকের জবানীতে, “গাড়ি এর মাঝে আবার ভোল ফিরিয়ে নিয়েছে। দাড়ি লম্বা হয়েছে, টিকি খাটো হয়েছে, নাদুসনুদুস লালজীদের মিষ্টি মিষ্টি ‘আইয়ে বৈঁঠিয়ে’ আর শোনা যায় না। এখন ছ’ফুট লম্বা পাঠানদের ‘দাগা, দাগা, দিলতা, রাওরা’, পাঞ্জাবীদের ‘তুসি, অসি’, আর শিখ সর্দারজীদের জালবন্ধ দাড়ির হরেক রকম বাহার। পুরুষ যে রকম মেয়েদের কেশ নিয়ে কবিতা লেখে এদেশের মেয়েরা বোধ করি সর্দারজীদের দাড়ি সম্বন্ধে তেমনি গজল গায়; সে দাড়িতে পাক ধরলে মরসিয়া-জারী গানে বার্ধক্যকে বেইজ্জৎ করে।”
এতো গেল পাঠান সর্দারজীদের দাড়ির বর্ণনা দিয়ে পরিচয় পর্ব। এবার আসুন তাদের জামা’র পরিচয় পর্বে।
“............জিজ্ঞাসা করলুম,‘সর্দারজী শিলওয়ার বানাতে ক’গজ কাপড় লাগে? বললেন,“দিল্লীতে সাড়ে তিন, জলন্ধরে সাড়ে চার, লাহোরে সাড়ে পাঁচ, লালামুসায় সাড়ে ছয়, রাওয়ালপিন্ডিতে সাড়ে সাত, তারপর পেশাওয়ারে এক লম্ফে সাড়ে দশ, খাস পাঠানমুল্লুক কোহাট খাইবারে পুরো থান।’
‘বিশ গজ!’
‘হ্যাঁ, তাও আবার খাকী শার্টিঙ দিয়ে বানানো’।...............” পড়ে ও জেনে অবাক হলাম। বিস্ময় আর বিস্ময়!
কি বিলাসী পোশাক তাই না? বিধিবাম, পরের পাতায় দেখেন উল্টো কথা,‘............ আপনি বুঝি ভেবেছেন, পাঠান প্রতি ঈদে নূতন শিলওয়ার তৈরী করায়? মোটেই না। ছোকরা পাঠান বিয়ের দিন শ্বশুরের কাছ থেকে বিশগজী একটা শিলওয়ার পায়। বিস্তর কাপড়ের ঝামেলা – এক জায়গায় চাপ পড়ে না বলে বহুদিন তাতে জোড়াতালি দিতে হয় না। ছিঁড়তে আরম্ভ করলেই পাঠান সে শিলওয়ার ফেলে দেয় না, গোঁড়ার দিকে সেলাই করে, পরে তালি লাগাতে আরম্ভ করে- সে যে-কোন রঙের কাপড় দিয়েই হোক, পাঠানের তাতে বাছবিচার নেই। বাকী জীবন সে ঐ শিলওয়ার পরেই কাটায়। মরার সময় ছেলেকে দিয়ে যায় – ছেলে বিয়ে হলে পর তার শ্বশুরের কাছ থেকে নূতন শিলওয়ার পায়, ততদিন বাপের শিলওয়ার দিয়ে চালায়।...........................’
আপনাকে যদি পাঠানের একটা একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি নিশ্চয়ই বলবেন তাদের বোকামির কথা। কিন্তু ভুল হবে, তাদের মূল বৈশিষ্ট্য হল আড্ডাবাজ। জী হ্যাঁ, তাদের মত আড্ডাবাজ আর পাবেন না। এই বইয়ে দেখুন লেখক কি বলেন,‘..............আড্ডা জমে উঠল। দেখলুম, পাঠানের বাইরের দিকটা যতই রসকষহীন হোক না কেন, গল্প শোনাতে আর গল্প বলাতে তাদের উৎসাহের সীমা নেই। তর্কাতর্কি করে না, গল্প জমাবার জন্য বর্ণনার রঙতুলিও বড় একটা ব্যবহার করে না। সব যেন উডকাটের ব্যাপার – সাদামাটা কাঠখোট্টা বটে, কিন্তু ঐ নীরস নিরলঙ্কার বলার ধরনে কেমন যেন একটা গোপন কায়দা রয়েছে যার জন্য মনের উপর বেশ জোর দাগ কেটে যায়।..............’।
আড্ডার জন্য তারা কি করে জানতে পাবেন আরও কয়েক জায়গায়, নমুনা দেখুন,‘..............পাঠান আড্ডা জমাবার খাতিরে অনেক রকম আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত। গল্পের নেশায় বে-খেয়াল অন্ততঃ আধ ডজন অতিথি সুদ্ধু শুকনো রুটি চিবিয়েই যাচ্ছে, চিবিয়েই যাচ্ছে। অবচেতন ভাবটা এই, পোলাও-মাংস বাছতে হয়, দেখতে হয়, বহুৎ বয়নাক্কা, তাহলে লোকের মুখের দিকে তাকাব কি করে, আর না তাকালে গল্প জমবেই বা কি করে।..............’
কি মজা পেলেন? আরও আছে,‘..............জানেন তো পাঠানেরা বড্ড আড্ডাবাজ। গল্পগুজব না করে সে এক মাইল পথও চলতে পারে না। কাউকে না পেলে সে বসে যাবে রাস্তার পাশে। মুচীকে বলবে,‘দাও তো ভায়া, আমার পয়জারে গোটা কয়েক পেরেক ঠুকে।’ মুচী তখন ঢিলে লোহাগুলো পিটিয়ে দেয়, গোটা দশেক নূতনও লাগিয়ে দেয়। এই রকম শ’খানেক লোহা লাগালে জুতোর চামড়া আর মাটিতে লাগে না, লোহার উপর দিয়েই রাস্তার পাথরের চোট যায়। হাফসোল লাগানোর খরচাকে পাঠান বড্ড ভয় করে কিনা। সেই পেরেক আবার হরেক রকম সাইজের হয়। পাঠানের জুতো তাই লোহার মোজায়িক। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, লোহা ঠোকানো না-ঠোকানো অবান্তর – মুচীর সঙ্গে আড্ডা দেবার জন্য ঐ তার অজুহাত।’ আড্ডা আর কৃপণতা, পাঠানের এই একটাই পরিচয়?
উল্টো কথা দেখুন,‘..............আর কী খানাপিনা! প্রতি ষ্টেশনে আড্ডার কেউ না কেউ কিছু না কিছু কিনবেই। চা, শরবৎ, বরফজল, কাবাব, রুটি, কোনো জিনিসই বাদ পড়ল না। কে দাম দেয়, কে খায়, কিচ্ছু বোঝবার উপায় নেই। আমি দু’একবার আমার হিস্যা দেবার চেষ্টা করে হার মানলুম। বারোজন তাগড়া পাঠানের তির্যকবূহ্য ভেদ করে দরজায় পৌঁছবার বহু পূর্বেই কেউ না কেউ পয়সা দিয়ে ফেলেছে। আপত্তি জানালে শোনেনা, বলে,‘বাবুজী এই পয়লা দফা পাঠানমুল্লুকে যাচ্ছেন, না হয় আমরা একটু মেহমানদারী করলুমই। আপনি পেশাওয়ারে আড্ডা গাড়ুন, আমরা সবাই এসে একদিন আচ্ছা করে খানাপিনা করে যাবো।’ আমি বললুম,‘আমি পেশাওয়ারে বেশী দিন থাকব না।’ কিন্তু কার গোয়াল, কে দেয় ধুঁয়ো। সর্দারজী বললেন,‘কেন বৃথা চেষ্টা করেন? আমি বুড়ো মানুষ, আমাকে পর্যন্ত একবার পয়সা দিতে দিল না। যদি পাঠানের আত্মীয়তা-মেহমানদারী বাদ দিয়ে এদেশে ভ্রমণ করতে চান, তবে তার একমাত্র উপায় কোনো পাঠানের সঙ্গে একদম কথা না বলা। তাতেও সবসময় ফল হয় না।..............’
লেখক পাঠানের অতিথিপরায়ণতার সার্টিফিকেট দিয়েছেন লেখক এভাবে,‘..............আজ বলতে পারি পাঠানের অভ্যর্থনা সম্পূর্ণ নির্জলা আন্তরিক। অতিথিকে বাড়িতে ডেকে নেওয়ার মত আনন্দ পাঠান অন্য কোন জিনিসে পায় না – আর সে অতিথি যদি বিদেশী হয় তা’হলে তো আর কথাই নেই। তারো বাড়া, যদি সে অতিথি পাঠানের তুলনায় রোগদুবলা সাড়ে পাঁচফুঢী হয়। ভদ্রলোক পাঠানের মারপিট করা মানা। তাই সে তার শরীরের অফুরন্ত শক্তি নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না। রোগদুবলা লোক হাতে পেলে আর্তকে রক্ষা করার কৈবল্যানন্দ সে তখন করে ..............’
ও হ্যাঁ পাঠানের শক্তির বর্ণনা লেখক ট্রেনে পাঠানদের সাথে পরিচয় পর্বে দিয়েছেন এভাবে,‘..............গরমে, ধুলোয়, কয়লার গুঁড়োয়, কাবাব-রুটিতে আর স্নানাভাবে আমার গায়ে তখন আর একরত্তি শক্তি নেই যে বিছানা গুটিয়ে হোন্ডল বন্ধ করি। কিন্তু পাঠানের সঙ্গে ভ্রমণ করাতে সুখ এই যে, আমাদের কাছে যে কাজ কঠিন বলে বোধ হয় পাঠান সেটা গায়ে পড়ে করে দেয়। গাড়ির ঝাঁকুনির তাল সামলে, দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে উপরের ব্যাঙ্কের বিছানা বাঁধা আর দেশলাইটি এগিয়ে দেওয়ার মধ্যে পাঠান কোন তফাৎ দেখতে পায় না। বাক্স-তোরঙ্গ নাড়াচাড়া করে যেন অ্যাটাচি কেস।..............’
পাঠানের রসবোধের বর্ণনা,‘..............লোকটার হিম্মৎ ছাড়া নাকি আরো একটা গুণ আছে। যাকে বলে হাজির-জবাব। সব কথার চটপট উত্তর দিতে পারে। শুনলুম চারবার প্রমাণ অভাবে খালাস পেয়ে পাঁচ বারের বার যখন হাকিম ইজাজ হুসেন খানের আদালতে উপস্থিত হল, তখন তিনি নাকি চটে গিয়ে বলেছিলেন,‘এই নিয়ে তুই পাঁচবার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিস; তোর লজ্জা-শরম নেই?’
সর্দার নাকি মুচকি হেসে বলেছিল, ‘হুজুর প্রমোশন না পেলে আমি কি করব?’ ..............’ হা হা হা।
আপনি কি জানেন সর্দারজীদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্ক কোনটা? আসুন দেখি,‘..............শেষটায় থাকতে না পেরে আমি বললুম,‘আপনি পণ্ডিত মানুষ, শোকে এত বিচলিত হচ্ছেন কেন? আর আপনার সহ্য করবার ক্ষমতা যে কত অগাধ সে তো আমরা সবাই দেখেছি – দুটি ছেলে, স্ত্রী মারা গেলেন, আপনাকে তো এতটুকু কাতর হতে দেখিনি’।
‘খুদাবখশ আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি বদ্ধ উম্মাদ। কিন্তু মুখে কথা ফুটল। বললেন,‘আপনি পর্যন্ত এই কথা বললেন? ছেলে মরেছিল তো কি? আবার ছেলে হবে। বিবি মরেছেন তো কি? নূতন শাদী করব। কিন্তু ভাই পাব কোথায়?’ ..............’
তবে পরে এসে মন ছুঁয়ে গেল এই লাইনগুলো,‘সৈয়দ সাহেব, কিছু মনে করবেন না। আপনারা বোমা মারেন, রাজনৈতিক আন্দোলন চালান, ইংরেজ আপনাদের ভয়ও করে। এসব তো আরম্ভ হয়েছে মাত্র সেদিন। কিন্তু বলুন তো, যেদিন দুনিয়ার কেউ জানত না ফ্রন্টিয়ার বলে এক ফালি পাথরভর্তি শুকনো জমিতে একদল পাহাড়ী থাকে সেদিন ইংরেজ তাদের মেরে শেষ করে দিত না, যদি পারত? ফসল ফলে না, মাটি খুঁড়লে সোনা চাঁদি কয়লা তেল কিছুই বেরোয় না, এক ফোঁটা জলের জন্য ভোর হবার তিন ঘণ্টা আগে মেয়েরা দল বেঁধে বাড়ি থেকে বেরোয়, এই দেশ কামড়ে ধরে পড়ে আছে মূর্খ পাঠান, কত যুগ ধরে, কত শতাব্দী ধরে কে জানে? সিন্ধুর ওপারে যখন বর্ষার বাতাস পর্যন্ত সবুজ হয়ে যায় তখন তার হাতছানি পাঠান দেখেনি? পূরবৈয়া ভেজা ভেজা হাওয়া অদ্ভুত মিঠে মিঠে গন্ধ নিয়ে আসে, আজ পর্যন্ত কত জাত তার নেশায় পাগল হয়ে পুব দেশে চলে গিয়েছে – যায়নি শুধু মূর্খ আফ্রিদী মোমন্দ’।
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ পড়া চলছে। রসিয়ে রসিয়ে পড়ছি... আর রস আস্বাদন করছি। পুরোটা পড়া শেষ হলে আবার আসছি...