“য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর" (ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই - পর্ব ০১)

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • “য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র” - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভ্রমণ সাহিত্য নিয়ে সুন্দর একটি কথা বলেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়, “ভ্রমণ থেকেই হয় ভ্রমণ কাহিনী। কিন্তু ভ্রমণকারীদের সকলের হাত দিয়ে নয়।' ইদানীং ভ্রমণ সাহিত্য পড়া শুরু করেছি। অবাক করা বিস্ময়ে দেখতে পাচ্ছি শক্তিমান সাহিত্যিকদের ভ্রমণ সাহিত্য শুধু সাহিত্য বা ভ্রমণ কাহিনী নয়, এ যেন একজন পারফেক্ট ট্রাভেলারের সাহিত্যর তুলিতে আকা তৈলচিত্র। যত পড়ছি, ততই বিস্ময়ে অভিভূত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। আর এই বোধ থেকেই মাথায় এলো “ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই” সিরিজের। প্রতিটি ভ্রমণ সাহিত্য পড়া শেষে সবার সাথে শেয়ার করাই এই সিরিজের উদ্দেশ্য। আজ প্রথম কিস্তিতে আসুন চোখ বুলাই বাংলা সাহিত্যর অবিসংবাদিত কীর্তিমান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র” বইটিতে। 
মাত্র সতেরো বছর বয়সে তরুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবারের মত বিদেশ যাত্রা করেন। এই যাত্রায় তার সাথে ছিলেন মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই গ্রন্থটি ঠিক কখন লেখা হয়েছিল তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় নাই। তবে রবীন্দ্রজীবনিকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, এই লেখাটির সূচনা হয়েছিল জাহাজে থাকতেই আর শেষ হয়েছিল ব্রাইটনে পৌছবার পর। ইউরোপ গমনের প্রায় একবছর পর এটি ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘য়ুরোপ-প্রবাসী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ শিরোনামে নিয়মিত ছাপা হয়েছিল।
এই গ্রন্থটি যেন আপনাকে এক লহমায় নিয়ে যাবে দেড়শত বছর আগেকার বিলেতে। একজন সম্পূর্ণ পর্যটকের ন্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবলোকন করেন তৎকালীন ইংল্যান্ডের জীবন ব্যাবস্থা, সেখানকার পরিবেশ ও প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও লোকাচার। লেখার পরতে পরতে আপনি পাবেন গভীর ও তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন। যা দেখেছেন, চেয়েছেন তার গভীরে লুকিয়ে থাকা ঘটনার স্বরূপ উম্মোচন করতে। লেখার পুরোটা জুড়ে আপনি দেখতে পাবেন তৎকালীন সময়ের দুই ভিন্ন সমাজের তুলনামূলক চিত্র। 
যাত্রাপথের বর্ণনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “........ রেলোয়ে করে যেতে যেতে আমরা Mont Cenis-এর বিখ্যাত সুরঙ্গ দেখলাম। এই পর্বতের এ-পাশ থেকে ফরাসিরা, ও-পাশ থেকে ইটালিয়ানরা, একসঙ্গে খুদতে আরম্ভ করে, কয়েক বৎসর খুদতে খুদতে দুই যন্ত্রিদল ঠিক মাঝামাঝি এসে পরস্পরের সমুখাসমুখি হয়। এই গুহা অতিক্রম করতে রেলগাড়ির ঠিক আধ ঘণ্টা লাগল। সে অন্ধকারে আমরা যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলেম। এখানকার রেলগাড়ির মধ্যে দিনরাত আলো জ্বালাই আছে, কেননা এক-এক স্থানে প্রায় পাঁচ মিনিট অন্তর এক-একটা পর্বতগুহা ভেদ করতে হয় - সুতরাং দিনের আলো খুব অল্পক্ষণ পাওয়া যায়। ইটালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা - নির্ঝর নদী পর্বত গ্রাম হ্রদ দেখতে দেখতে আমরা পথের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম............” এরূপ বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন অতি চতুরতার সাথে। 
একজন লেখকের রসবোধের কারণে একটি ভ্রমণ সাহিত্য কতটা উপভোগ্য হয়ে উঠে তা এই গ্রন্থটি না পড়লে বুঝা যাবে না। একটি অংশ তুলে ধরলাম, "............... প্যারিসে পৌঁছিয়েই আমরা একটা 'টার্কিশ-বাথে' গেলেম। প্রথমত একটা খুব গরম ঘরে গিয়ে বসলেম, সে-ঘরে অনেকক্ষন থাকতে থাকতে কারো কারো ঘাম বেরতে লাগল, কিন্তু আমার তো বেরল না, আমাকে তার চেয়ে আর-একটা গরম ঘরে নিয়ে গেল, সে ঘরটা আগুনের মতো, চোখ মেলে থাকলে চোখ জ্বালা করতে থাকে, মিনিট কতক থেকে সেখানে আর থাকতে পারলেম না, সেখান থেকে বেড়িয়ে খুব ঘাম হতে লাগল। তার পরে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমাকে শুইয়ে দিলে। ভীমকায় এক ব্যাক্তি এসে আমার সর্বাঙ্গ ডলতে লাগল। তার সর্বাঙ্গ খোলা, এমন মাংসপেশল চমৎকার শরীর কখনো দেখিনি............" হা হা হা। 
ইংল্যান্ডের বৃষ্টি সেই আমল থেকেই খুব বিখ্যাত ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানকার আবহাওয়ার বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন, “........................মেঘ, বৃষ্টি, বাদল, অন্ধকার, শীত-এ আর একদণ্ডের তরে ছাড়া নেই। আমাদের দেশে যখন বৃষ্টি হয় তখন মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ, মেঘ, বজ্র, বিদ্যুৎ, ঝড়-তাতে একটা কেমন উল্লাসের ভাব আছে; এখানে তা নয়, এ টিপ টিপ করে সেই একঘেয়ে বৃষ্টি ক্রমাগতই অতিনিঃশব্দ পদসঞ্চারে চলছে তো চলছেই। রাস্তায় কাদা, পত্রহীন গাছগুলো স্তব্ধভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে, কাঁচের জানালার উপর টিপ টিপ করে জল ছিটিয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে স্তরে স্তরে মেঘ করে; এখানে আকাশ সমতল, মনে হয় না যে মেঘ করেছে, মনে হয় কোনো কারণে আকাশের রঙটা ঘুলিয়ে গিয়েছে, সমস্তটা জড়িয়ে স্থাবরজঙ্গমের একটা অবসন্ন মুখশ্রী। লোকের মুখে সময়ে সময়ে শুনতে পাই বটে যে, কাল বজ্র ডেকেছিল, কিন্তু বজ্রের নিজের এমন গলার জোর নেই যে তার মুখ থেকেই সে খবরটা পাই। সূর্য তো এখানে গুজবের মধ্যে হয়ে পড়েছে...........................” ।
সেখানকার মানুষের পরিচয় করাতে গিয়ে তিনি বলেন, “.....................মেয়েরা বেশভূষায় লিপ্ত, পুরুষেরা কাজকর্ম করছে, সংসার যেমন চলে থাকে তেমনি চলছে, কেবল রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিশেষভাবে কোলাহল শোনা যায়। মেয়েরা জিজ্ঞাসা করে থাকে, তুমি নাচে গিয়েছিলে কি না, কনসার্ট কেমন লাগল, থিয়েটারে একজন নতুন অ্যাক্টর এসেছে, কাল অমুক জায়গায় ব্যান্ড হবে ইত্যাদি। পুরুষেরা বলবে, আফগান যুদ্ধের বিষয়ে তুমি কি বিবেচনা করক, -কে লন্ডনীয়েরা খুব সমাদার করেছিল, আজ দিন বেশ ভালো, কালকের দিন বড়ো মিজরেবল ছিল। এ দেশের মেয়েরা পিয়ানো বাজায়, গান গায়, আগুনের ধারে আগুন পোয়ায়, সোফায় ঠেসান দিয়ে নভেল পড়ে, ভিজিটরদের সঙ্গে আলাপচারি করে ও আবশ্যক বা অনাবশ্যক মতে যুবকদের সঙ্গে ফ্লার্ট করে। এ দেশের চির-আইবুড়ো মেয়েরা কাজের লোক। টেমপারেন্স মীটিং, ওয়াকিং মেনস সোসাইটি প্রভৃতি যতপ্রকার অনুষ্ঠানের কোলাহল আছে, সমুদয়ের মধ্যে তাদের কণ্ঠ আছে। পুরুষদের মতো তাদের আপিসে যেতে হয় না, মেয়েদের মতো ছেলেপিলে মানুষ করতে হয় না, এ দিকে হয়তো এত বয়স হয়েছে যে 'বলে' গিয়ে নাচা বা ফ্লার্ট করে সময় কাটানো সংগত হয় না, তাই তারা অনেক কাজ করতে পারেন, তাতে উপকারও হয়তো আছে...........................”। কি অবলীলায় চরম সত্য কথা বলে গেলেন, এততুকু দ্বিধা ছাড়া। 
আরেক জায়গায় তার বর্ণনা দেখুন, যা পড়ে খুব মজা পেয়েছি, “..............................যা হোক এখানকার ঘর-দুয়ারগুলি বেশ পরিস্কার; বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলে কোথাও ধুলো দেখবার জো নেই, মেজের সর্বাঙ্গ কার্পেট প্রভৃতি দিয়ে মোড়া, সিঁড়িগুলি পরিস্কার তক তক করছে। চোখে দেখতে খারাপ হলে এরা সইতে পারে না। অতি সামান্য বিষয়ে এদের ভালো দেখতে হওয়াটা প্রধান আবশ্যক। শোকবস্ত্ও সুশ্রী দেখতে হওয়া চাই। আমরা যাকে পরিস্কার বলি সেটা কিন্তু আর-একটা জিনিস।
 ..................................................................................................................................................................... এখানে যেরকম কাশি-সর্দির প্রাদুর্ভাব, তাতে ঘরে একটা পিকদান নিতান্ত আবশ্যক, কিন্তু তার ব্যবহার কুশ্রী বলে ঘরে রাখা হয় না, রুমালে সমস্ত কাজ চলে। আমাদের দেশে যেরকম পরিস্কার ভাব, তাতে আমরা বরঞ্চ ঘরে একটা পিকদানি রাখতে পারি, কিন্তু জামার পকেটে এরকম একটা বীভৎস পদার্থ বহন করতে ঘৃণা হয় ..................................................................................................................................................................... এখানকার দাসীদের কোমরে এক আঁচল বাঁধা থাকে, সেইটি দিয়ে তারা না পোঁছে এমন পদার্থ নেই; খাবার কাঁচের প্লেট যে দেখছে ঝকঝক করছে, সেটিও সেটিও সেই সর্ব-পাবক-আঁচল দিয়ে মোছা হয়েছে, কিন্তু তাতে কী হানি, কিছু খারাপ দেখাচ্ছে না। এখনাকার লোকেরা অপরিষ্কার নয়, আমাদের দেশে যাকে 'নোংরা' বলে তাই..........................................” শুধু সেই দেশের লোকজনের কথাই নয়, তিনি বলেছেন নিজের, নিজ দেশের এবং বিশেষ করে স্বদেশী ইঙ্গবঙ্গদের সম্পর্কে, “..................এইবার ইঙ্গবঙ্গদের একটি গুণের কথা তোমাকে বলছি। 
এখানে যারা আসেন, অনেকেই কবুল করেন না যে তাঁরা বিবাহিত, যেহেতু স্বভাবতই যুবতী কুমারী সমাজে বিবাহিতদের দাম অল্প। অবিবাহিত বলে পরিচয় দিলে এখনকার অবিবাহিতদের সঙ্গে মিশে অনেক যতেচ্ছাচার করা যায়, কিন্তু বিবাহিত বলে জানলে তোমার অবিবাহিত সঙ্গীরা ও-রকম অনিয়ম করতে দেয় না; সুতরাং অবিবাহিত বলে পরিচয় দিলে অনেক লাভ আছে..............” 
 এরকম শতরকমের ব্যাঙ্গাত্মক বিবরণ আর রসালো উক্তি দিয়ে সাজান ভ্রমণসাহিত্য “য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র”। বিভিন্ন প্রকাশনী হতে এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে। আপনি সহজেই বইটি সংগ্রহ করে পড়ে নিতে পারেন এই চমৎকার বইটি। বাংলাদেশে “প্রথমা” এবং “কথাপ্রকাশ” থেকে “রবীন্দ্র ভ্রমণ সাহিত্য সমগ্র” বের হয়েছে। মূল্য তিনশত থেকে পাঁচশত টাকার ভেতরে। এক মলাটের ভেতরে সব কয়টি রবীন্দ্র ভ্রমণ সাহিত্য! এরচেয়ে ভালো আর কি হতে পারে? পরের পর্ব

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ