শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠা একটু কষ্টকর বটে। তার মধ্যে আগের রাতে ঘুমোতে যেতে দেরী হলে তো কথাই নেই। মোবাইলের কর্কশ রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো, বন্ধু মনা ফোন দিয়েছে। “তুই কি রেডি?” প্রশ্ন শুনে চোখ ভরা রাজ্যের ঘুম নিয়ে বিছানা ছেড়ে ভোঁ দৌড় ওয়াশরুমের দিকে। দ্রুত রেডি হয়ে সকাল পৌনে সাতটার দিকে পৌঁছলাম। আগে থেকে মনা সস্ত্রীক দাঁড়িয়ে ছিল, আমি পৌছবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মাইক্রবাস এসে গেলে আমরা তিনজন উঠে পরে রওনা হলাম ভ্রমন বাংলাদেশ আয়োজিত “রাজবাড়ীতে সারাদিন” নামক ইভেন্টে। পথে একে একে বিভিন্ন স্পট হতে আরও দশজন ভ্রমণসাথীকে সাথে করে রওনা হলাম মানিকগঞ্জের দিকে, গন্তব্য আরিচাঘাট সংলগ্ন “তেওতা জমিদার বাড়ী”।
ভ্রমণ বাংলাদেশ প্রতি মাসেই আয়োজন করে ডে-লং ইভেন্টের, ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে বেড়িয়ে পরে ঢাকার আশেপাশের গন্তব্যে। এবার তেওতা জমিদার বাড়ীতে ইভেন্টটি হওয়াতে সুবিধা হল আমার। আরেকটি জমিদার বাড়ী দর্শনের সুযোগ, সাথে আমার "বাংলার জমিদার বাড়ী" সিরিজের জন্য আরেকটি লেখার সুযোগ।
দেশের পুরাকীর্তি স্থাপনার মধ্যে মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদার বাড়ী ইতিহাস অন্যতম। এর বাড়ির ঐতিহাসিক নির্দর্শন এখন শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিবালয় উপজেলার যমুনা নদীর কূলঘেঁষা সবুজ-শ্যামল গাছপালায় ঢাকা তেওতা গ্রামটিকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে জমিদার শ্যামশংকর রায়ের প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন মঠটি। অনেকদূর থেকেই দেখা যেত শ্বেতশুভ্র নবরত্ন মঠ।
এক সময়ে জমিদারের বাড়ির আঙিনার এই মঠকে ঘিরে দোলপূজা আর দুর্গাপূজার রঙিন উৎসব পালিত হতো। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার এই তেওতা গ্রামটি আরও বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী প্রমীলার স্মৃতি জড়িয়ে থাকায়। তেওতা গ্রামের মেয়ে প্রমীলা। জমিদারবাড়ী পাশেই বসন্তকুমার সেন আর গিরিবালা সেন দম্পতির মেয়ে আশালতা সেন বা প্রমীলা নজরুল। এর ডাক নাম দুলি। ছন্নছাড়া, ভবঘুরে নজরুল কয়েক দফায় এসেছিলেন এই গ্রামে। তবে এখানে কেন এসেছিলেন এ নিয়ে জনমনে রয়েছে নানান বিতর্ক।
তবে জনশ্রুতি হয়েছে ১৯২২ সালে প্রমীলার সাথে একবার এসেছিলেন এটি প্রায় সবাই সায় দেয়। ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাসে নজরুলের লেখা ‘‘আনন্দময়ীর আগমনে’’ কবিতাটি ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশ হলে ব্রিটিশ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। প্রমীলাকে নিয়ে তেওতা গ্রামে আত্মগোপন করেন নজরুল। আত্মগোপনে থাকতে আসলেও দুরন্ত নজরুল অবশ্য ঘরের কোনে বসে থাকেননি। যমুনার ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা সবুজ শ্যামল পাখিডাকা তেওতা গ্রামে ছুটে বেরিয়েছেন। গান, কবিতা আর অট্টহাসিতে পুরো গ্রামের মানুষকে আনন্দে মাতিয়েছেন। কখন ও বা জমিদার বাড়ির শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে রাতের বেলায় করুণ সুরে বাঁশি বাজিয়ে বিমোহিত করেছে রাতজাগা গ্রামের মানুষকে।
জমিদার কিরণশঙ্কর রায়ের আমন্ত্রনে একবার নজরুল তার অতিথি হয়ে আসেন। আর সে সময়ই নজরুল এবং প্রমীলার দেখা হয়েছিল। জমিদারবাড়ীর পাশের বাড়ি বসন্তকুমারের মেয়ে দুলি (প্রমীলা) ছিলেন তখনকার জমিদার কিরণ শঙ্কর রায়ের স্নেহধন্য। বেড়াতে এসে নজরুল জমিদারবাড়ীতে প্রতি রাতেই গান-বাজনার আসর বসাতেন। আর সেখানে একমাত্র গায়ক ছিলেন নজরুল। দুলি তখন মাত্র কয়েক বছরের বালিকা। নজরুল গানের ফাঁকে ফাঁকে পান খেতেন। আর দুলির দায়িত্ব ছিল তার হাতে পান তুলে দেয়া। হয়তো এর মাধ্যমেই নজরুল প্রমীলার পরিচয় আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে।
বিয়ের পর তেওতার জমিদার কিরণ শঙ্কর রায়ের আমন্ত্রণে নজরুল নববধূকে নিয়ে আবার তেওতায় আসেন। প্রায় দুই সপ্তাহ থাকার সময় জমিদারবাড়ীতে নজরুলের গান ও কবিতার আসর বসতো। দর্শকের আসনে জমিদার পরিবারের পাশে প্রমীলাও থাকতো। আর নজরুল যখন ‘‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ.... অথবা, মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল. গান গাইতেন তখন লজ্জায় রক্তিম হতেন প্রমীলা।
ভবঘুরে জীবনে নজরুল যেখানেই গেছেন সেখানেই তিনি কিছু না কিছু রচনা করেছেন। তেওতার স্মৃতি নিয়েও তিনি অনেক কবিতা গান সৃষ্টি করেছেন বলে নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলামের গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। এমনই একটি হচ্ছে নজরুলের ‘‘লিচু চোর কবিতা’’। তেওতার জমিদারদের স্থানীয়ভাবে বলা হতো বাবু। আর তাদের বিশাল পুকুর ঘিরে তাল গাছ থাকায় বলা হতো তালপুকুর। প্রাচীর ডিঙিয়ে এই পুকুর পাড়ের গাছ থেকে একটি বালক লিচু চুরি করতে গিয়ে মালি ও কুকুরের তাড়া খাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে নজরুল এই কবিতাটি রচনা করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা মনে করেন বলে রফিকুল ইসলাম তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও তেওতা গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনা নদীর স্মৃতিতে বেশ কিছু গান ও কবিতা লিখেছেন। যেমন নীল শাড়ি পরে নীল যমুনায় কে যায়। কেন প্রেম যমুনা আজি হলো অধীর। আজি দোল ফাগুনে দোল লেগেছে.....বৃন্দাবনে প্রেম যমুনায়। যমুনা কূলে মধুর মধুর মুরলী সখি বাজিল। যমুনা সিনানে চলে তীরে মরাল । চাঁপা রঙের শাড়ি আমার যমুনা নীর ভরণে গেল ভিজে।
আমাদের তেরজনের দলটি পথে একটি রোডসাইড রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা সারতে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম। পরোটা, ডিমভাজি, সবজি, গিলাকলিজি দিয়ে নাস্তা সেরে সাথে গরম গরম চা। এখানে কিছুক্ষন ফটোসেশন চলল, ঘণ্টাখানেক পরে আবার যাত্রা শুরু, গাড়ি চলতে লাগলো তেওতার উদ্দেশ্যে, সাথে গাড়ীর ভেতরে চলল সমান তালে আড্ডা। বারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম তেওতা। দূর থেকেই শ্বেতশুভ্র মন্দির সবার দৃষ্টি কেড়ে নিলো। জুম্মাবার থাকায় ছেলের দল ছুটলাম পাশের মসজিদের দিকে, মেয়েরা জমিদার বাড়ী সংলগ্ন পুকুর পাড়ে অলস সময় কাঁটালো। নামাজ শেষে সবাই মিলে ঢুকলাম ইতিহাসের দরজায়, অর্থাৎ তেওতা জমিদার বাড়ীতে।
এই জমিদার বাড়িটি বাবু হেমশংকর রায় চৌধুরী, বাবু জয় শংকর রায় চৌধুরী, দুই ভাইয়ের নিজ বসতবাড়ি ছিল। এখান থেকেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। মূল বাড়ীতে ৫৫টি ঘর ছিল। এই বাড়ির বেশ কয়েকটি সিঁড়ি আছে যা দিয়ে ছাদে ওঠা যায় এখনও। বাড়ী সংলগ্ন দুটি পুকুর ছিল সেই সময়, এর একটি এখনও বিদ্যমান রয়েছে। বাড়ির অভ্যন্তরেই ছিল দুটি মন্দির আর একটা মঠ। চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর নবরত্ন মন্দিরটি এখনও বেশ ভালো অবস্থায় টিকে আছে।
এখানে সেখানে ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় পরিধেয় জামাকাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে। দেখে মন খারাপ হয়। জমিদার বাড়ী ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে আমরা একসময় ছাদে উঠে এলাম। জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ।
উপকথা অনুযায়ী তেওতা গ্রামের পাঁচু সেন বাল্যবয়সে পিতৃহারা হন। বিধবা মা এ বাড়ী ও বাড়ী কাজ করে অনেক কষ্টে পাঁচুকে বড় করেন। একদিন পাঁচু মায়ের কাছে মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার বায়না ধরে। তাই একদিন গ্রামেরই এক জেলের কাছ থেকে বাকিতে দুই পয়সার মাছ কেনেন মা। দুপুরে জেলে যখন বাড়ী যাবে তখন পয়সা দিবেন। দুপুরে মাছ রান্না করে পাঁচুকে ভাত বেড়ে দিয়েছেন মা, ঠিক তখনই জেলে বাড়ীতে পয়সা নিতে হাজির। কিন্তু তখনো পয়সা জোগাড় হয়নি। বদমাইশ জেলে তখন রান্না করা মাছই তুলে নিয়ে যায়। ক্ষোভে-দুঃখে পাঁচু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। যমুনা পার হয়ে হাজির হয় গোয়ালন্দ ঘাটে। সেখানে এক মাড়োয়ারির কাছে কাজ শুরু করে। তারপর নিজ বুদ্ধি আর পরিশ্রমে একসময় পাঁচু নিজেই ব্যবসা শুরু করে। এরপর টাকাপয়সার মালিক হয়ে তেওতায় মায়ের কাছে ফিরে আসে। আশেপাশের দশ গ্রামের বেশীরভাগ জমিই কিনে নেয় মায়ের জন্য। পাঁচুর পরবর্তী বংশধরেরাই তেওতায় জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে।
তেওতা জমিদার বাড়ী দেখে আমরা আরিচাঘাটে এসে টাটকা মাছ-ভাতডাল দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। এরপরে সবার অনুরোধে ছুটলাম আরেক জমিদার বাড়ী “বালিয়াটি প্যালেসে”। মাস তিনেক আগেই একবার ঘুরে গেছি, যা নিয়ে এই সিরিজেই লেখা দিয়েছি। এবার গিয়ে লাভ হল একটি মূল জমিদার প্রাসাদের ভেতরে কিছু কন্সট্রাকশন কাজ চলায় ভেতরে ঢুঁকে ঘুরে দেখেছি সবাই। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল রঙতুলিতে আঁকা সারা ঘর এবং সিলিং জুড়ে থাকা আলপনা আর নকশা। অনেক শুনেছিলাম এটার কথা, এবার দেখাও হয়ে গেল। সেখানে শেষ বিকেলটা কাটিয়ে আমরা ফিরতি পথ যখন ধরলাম তখন সন্ধ্যা মিইয়ে গিয়ে রাতের ঝাঁপি চারিপাশে। আর এবারের এই যাত্রায় সারাটা পথ মাতিয়ে রেখেছিল দুই ক্ষুদে ভ্রমণসাথী, দুই বছরে দুই বাবু, শাহরিয়ার-মুন দম্পতির ছেলে আর মনিরের মেয়ে। রাত নয়টা নাগাদ ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে যখন বাসায় পৌঁছলাম রাত তখন প্রায় দশটা।
কিভাবে যাওয়া যায়:
ঢাকা থেকে বাসে আরিচা ঘাট এসে নামতে হবে। এরপর সি এন জি অথবা রিক্সা যোগে তেওতা যেতে হবে।এছাড়া নদী পথেও আসা যাবে। এজন্য নৌকায় আরিচাঘাটে এসে নামতে হবে। যমুনা নদী দিয়ে বাংলাদেশের যেকোন পয়েন্টে থেকে তেওতা জমিদারবাড়ী আসা যাবে।