ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর রাজবাড়ি - "বাংলার জমিদার বাড়ীঃ পর্ব ০৬"

ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর রাজবাড়ি  - 'বাংলার জমিদার বাড়ীঃ পর্ব ০৬'

ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর রাজবাড়ি

  • ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর রাজবাড়ি
  • ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর রাজবাড়ি
ঘোলাটে কুয়াশার চাদরে মোড়া ভোরবেলায় পায়ের নিচে শিশিরভেজা ঘাস,আর হাড়কাঁপানো কনকনে শীতে জড়সড় হয়ে ঘুরে বেড়াতে আপনাকে ডাক দিচ্ছে এখন উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের প্রকৃতির রূপ। এমন দিনে সেখানে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। ঘুরে ঘুরে দেখতে পারেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিচিহ্নগুলো। টাঙ্গন, শুক ও সেনায়া বিধৌত এই জনপদের একটি ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে বৃটিশ শাসনমলে বর্তমান পৌরসভা এলাকার কাছাকাছি কোনো স্হানে একটি থানা স্হাপিত হয়। এই পরিবারের নাম অনুসারে থানাটির নাম হয় ঠাকুরগাঁও থানা। "ঠাকুর" অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের সংখ্যাধিক্যের কারণে স্হানটির নাম ঠাকুরগাঁও হয়েছে। আর এই ঠাকুরগাঁও এর হরিপুর রাজবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। 
জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ। জমিদার বাড়ী সিরিজের সব লেখাঃ "বাংলার জমিদার বাড়ী" 
ঠাকুরগাঁও হরিপুর উপজেলার কেন্দ্রস্থলে হরিপুর রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ি ঘনশ্যাম কুন্ডুর বংশধরদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। মুসলিম শাসনামলে আনুমানিক ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ঘনশ্যাম কুন্ডু নামক একজন ব্যবসায়ী এন্ডি কাপড়ের ব্যবসা করতে হরিপুরে আসেন। সেই সময়ে মেহেরুন্নেসা নামে এক বিধবা মুসলিম মহিলা অত্র অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। তাঁর বাড়ি মেদিনীসাগর গ্রামে। এই জমিদারির খাজনা দিতে হতো তাজপুর পরগনার ফৌজদারের নিকট। খাজনা অনাদায়ের কারণে মেহেরুন্নেসার জমিদারির কিছু অংশ নিলাম হয়ে গেলে ঘনশ্যাম কুন্ডু কিনে নেন। ঘনশ্যামের পরবর্তী বংশধরদের একজন রাঘবেন্দ্র রায় উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বৃটিশ আমলে হরিপুর রাজবাড়ির কাজ শুরু করেন। কিন্তু তাঁর সময়ে রাজবাড়ির কাজ শেষ হয়নি। রাঘবেন্দ্র রায়ের পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে রাজবাড়ির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। এসময় তিনি বৃটিশ সরকার কর্তৃক রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯০০ সালের দিকে ঘনশ্যামের বংশধররা বিভক্ত হয়ে গেলে হরিপুর রাজবাড়িও দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। 
জগেন্দ্র নারায়ণ রায়ের সমাপ্তকৃত রাজবাড়ির দ্বিতল ভবনে লতাপাতার নকশা এবং পূর্ব দেয়ালের শীর্ষে রাজর্ষি জগেন্দ্র নারায়ণের চৌদ্দটি মূর্তি আছে। তাছাড়া ভবনটির পূর্বপাশে একটি শিবমন্দির এবং মন্দিরের সামনে নাট্যশালা রয়েছে। রাজবাড়িতে ছিল একটি বড় পাঠাগার যার অস্তিত্ব এখন নেই। রাজবাড়িটির যে সিংহদরজা ছিল সেটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। 
রাঘবেন্দ্র-জগেন্দ্র নারায়ণ রায় কর্তৃক নির্মিত রাজবাড়িটি বড় তরফের রাজবাড়ি নামে পরিচিত। এই রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে নগেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌঃ ও সিরিজা নারায়ণ চৌঃ ১৯০৩ সালে আরেকটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন যার নাম ছোট তরফ। ছোট তরফের রাজবাড়ির সামনে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে আনুমানিক ৪০০ বছরের পুরাতন একটি শিবমন্দির আছে। জোড়বাংলা পদ্ধতিতে মন্দিরটি তৈরি। মন্দিরটির চারদিকের দেয়ালে রয়েছে টেরাকোটা নকসা। মন্দিরটির দক্ষিণে একটি দরজা এবং পুর্ব ও পশ্চিম দেয়ালে একটি করে ক্ষুদ্রাকৃতির জানালা আছে। অনুমান করা হয় যে শিব মন্দিরটি ঘন-শ্যাম কুণ্ডু বা তার নিকটবর্তী বংশধরদের দ্বারা নির্মিত। হরিপুরের এ ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়িটি এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পরিত্যক্ত এ রাজবাড়ির বিভিন্ন কক্ষ স্থানীয় মহিলা সমিতি, ভূমি অফিসার্স সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন অফিস হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। রাজা ও রাজ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এটি সংস্কার করা উচিত। ঢাকার শ্যামলী, কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন কোম্পানির বাস ছেড়ে যাচ্ছে ঠাকুরগাঁওয়ের উদ্দেশে। তারপর ঠাকুরগাঁও থেকে বাস কিংবা ব্যাটারিতচালিত অটোরিকশায় করে হরিপুর রাজবাড়ি। এ ছাড়াও আরো দেখতে পাবেন দেশজুড়ে পরিচিত বড় আমগাছটি। চাইলে পঞ্চগড়ের চা বাগান এলাকা তেঁতুলিয়া ও জিরো পয়েন্ট এলাকা বাংলাবান্ধাও ঘুরে আসতে পারেন।
আগের পর্ব পরের পর্ব

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ