আচঁলে মেঘনার মায়া ডাকাতিয়া বুক বয়ে চলে মৃদু এঁকে বেঁকে নারিকেল সুপারি আর ধানক্ষেতের সবুজে ঘেরা লক্ষ্মীপুর জেলা। এই লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার ইউনিয়ন দালালবাজার। বাজার হতে একটু ভেতরে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে বাম দিকে একটি সরু গলি দেখতে পাবেন। সেই গলি’র ভেতরের গ্লানি আর দুঃখভরাক্রান্ত ভগ্নদেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দালাল বাজার জমিদার বাড়ী। ভগ্ন এই দেহ’র মাঝে যে নির্মাণশৈলী আপনি দেখতে পাবেন, তা দেখে বুঝে নিতে কষ্ট হবে না কি অপূর্ব ছিল এই জমিদার বাড়ীটি। তবে কষ্ট পাবেন এর পরিত্যাক্ত আর ভগ্নরূপ দেখে।
জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ।
দালালবাজারের জমিদার লক্ষ্মী নারায়ণের বাড়ী, যার নামে লক্ষ্মীপুর নামকরণ হয়েছে। লক্ষ্মী নারায়ন বৈষ্ণব প্রায় ৪ শত বছর পূর্বে কলকাতা থেকে কাপড়ের ব্যবসা করতে দালাল বাজার আসেন। তার উত্তর পুরুষরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক এজেন্সী এবং পরে জমিদারী লাভ করেন। বাণিজ্যিক এজেন্ট হওয়ায় স্থানীয়রা তাদেরকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেনি। তাদের ‘দালাল’ বলে আখ্যায়িত করেন। ১৯৪৬ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জমিদারগণ পালিয়ে গেলে তাদের পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ীটি রয়ে যায়। এটি আজ সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের মুখে।
প্রায় ৫ একরের এ জমিদার বাড়ীর সম্মুখের রাজগেট, রাজ
প্রাসাদ, জমিদার প্রাসাদ, অন্দর মহল প্রাসাদ, বাড়ীর প্রাচীর, শান বাঁধানো ঘাট, নাট মন্দির, পুজা মন্ডপ, বিরাটাকারের লোহার সিন্দুক, কয়েক টন ওজনের লোহার ভীম প্রভৃতি দেখার জন্য দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। বিচার আসন ও নৃত্য আসন কে বা কারা সম্প্রতি নিয়ে গেছে।
আমি যখন দালালবাজার পৌঁছই, তখন প্রায় শেষ বিকেল। বাজারে লোকদের জিজ্ঞাসা করতেই পথ দেখিয়ে দিল। একটু হতাশ হলাম সরু গলি দিয়ে ঢুঁকে। একটি প্রাচীন লাল ইটের পরিত্যাক্ত দেয়ালের পেছনে কিছু অবকাঠামো দেখে। সেখানে কয়েকজন শিশুকে খেলতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম পেছনে কি আছে। তার হেসে দিয়ে আবার খেলায় মত্ত হল। পাশে একটা টিনের একচালা ঘর হতে একজন মাঝবয়সী মহিলা বের হতে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, পেছনে জমিদার বাড়ীর ভগ্নদেহ পরে আছে, প্রায়ই নাকি লোকজন আসে দেখতে।
বড় বড় আগাছা ডিঙ্গিয়ে ভেতরে ঢুকতে যেতেই কয়েকটা কুকুর তেরে এল। ভয় পেয়ে পিছিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বছর পনেরর এক কিশোর আমার পথপ্রদর্শক হল, তার সাথে পেছন দিয়ে জমিদার বাড়ীর মূল অংশে ঢুকলাম। আহ, একি! অপূর্ব নির্মাণ শৈলীর এক ভগ্নদেহাবশেষ! কিছু ছবি তুলে ঝটপট বের হয়ে এলাম। কারন আমাকে আরও কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে যে। সাথে নিয়ে এলাম একগাদা মন খারাপের অনুভুতি।
যেভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে সড়কপথে গ্রীনল্যান্ড এক্সপ্রেস, আলবারাকা, আলম, ইকোনো অথবা ঢাকা এক্সপ্রেসে লক্ষ্মীপুর যেতে পারেন। সময় লাগে সাড়ে ৪ ঘন্টা। বাস ছাড়ে সায়েদাবাদ থেকে। সেখান থেকে রায়পুর এসে রিকশা নিয়ে এখানে যাবেন। ভাড়া নেবে ২০ টাকা।