কংস থেকে সোমেশ্বরী (প্রথমাংশ)

কংস থেকে সোমেশ্বরী (প্রথমাংশ)

গল্পের ছবিসকল

  • কংস নদী
  • নিঃসঙ্গ নৌকোখানি
  • কংস নদীতে শেষ বিকেলের আলো
  • মোটর সাইকেল করে এই পথ ধরেই নেত্রকোনা সদর থেকে বিরিশিরি এসেছি আমি আর হাসিব
  • ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে, কি কথা তাহার সাথে...
  • এই ফেব্রুয়ারীতেও সন্ধ্যার পর কুয়াশা নেমেছে চারিধারে 
  • নদীর তীরবর্তী গ্রাম্য এলাকা সন্ধ্যার পর
  • শীতকালে পানি কমে গিয়ে সোমেশ্বরী'র প্রায় জায়গাতেই বালির চর জেগে উঠে
  • সেই রাতের বারবিকিউ চিকেন
'বালুয়া বালশিরিরি’ একটি গারো শব্দ। এই শব্দটি থেকেই বিরিশিরি নামের উৎপত্তি। তবে অনেকেই বীরের শির থেকে বিরিশিরি নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করেন। সেই টিনএজের শেষে সবেমাত্র এইচ.এস.সি. পাশ করেছি, বন্ধু মনা বলল চল বিরিশিরি যাই... কিন্তু সেই থেকে প্ল্যান থাকে বিরিশিরি যাবো, কিন্তু আর যাওয়া হয় না। প্রায় এক যুগের বেশী সময় পর প্রথম যাই বিরিশিরি। এই ফাঁকে মনা মিয়া কিন্তু সারা দেশ ঘুরে শেষ করেছে, বিরিশিরি গিয়েছে কয়েকবার। আমার আর যাওয়া হয় না। সেই আক্ষেপ গতবার মিটেছে। কিন্তু এবারের বিরিশিরি ট্যুরটা ছিল অসাধারণ। 
গত শুক্রবার ফজরের পরপর “ভ্রমণ বাংলাদেশ” এর সভাপতি আরশাদ হোসেন টুটুল, প্রোগ্রাম অর্গানাইজার সবার প্রিয় তাহসিন মামার। নেতৃত্বে ৪ জনের দল দুইভাগে ভাগ হয়ে দুটি মাইক্রবাস নিয়ে বেড়িয়ে পরে। আমি ছিলাম টুটুল ভাইয়ের গাড়ীতে। শীতের সকাল, তার উপর শুক্রবারের দিন হওয়াতে এতো সকালে কোন পরিবহণ পেতে অসুবিধা হবে বলে আমাদের সবাইকে নিজেদের বাসার কাছ থেকে তুলে নিয়ে সকাল আটটার দিকে রওনা দেই নেত্রকোনা অভিমুখে। 
আজিমপুর থেকে রওনা হয়ে ঝিগাতলা থেকে এক দম্পতিকে তুলে নিয়ে শ্যামলী শিশুমেলার কাছ থেকে আরেক দম্পতিকে তুলে নেয়ার কথা। এখানে একটা মজার ঘটনা ঘটলো। এই ট্রিপে "ভ্রমণ বাংলাদেশ" এর সাথে মাহবুব ভাইদের প্রথম যুক্ত হওয়া, অনলাইন এবং ফোনে কথা হয়েছিলো, ফলে তাদের চেনা ছিলো না। সেই সাত সকালে শিশুমেলার কাছে দুইটা দম্পতি একটা করে বাচ্চা নিয়ে ট্যুরের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমাদের গাড়ী একটা দম্পতি'র কাছে গিয়ে ব্রেক কষে মাইক্রোবাসের গেট খুলে দিতে তাঁরা উঠে পড়ার পর কি মনে করে জিজ্ঞাসা করলাম, "বিরিশিরি? ভ্রমণ বাংলাদেশ?"। তখন জানা গেল যে, না... এরা নয়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অন্য দম্পতি মূলতঃ আমাদের কাঙ্ক্ষিত দম্পতি। যাই হোক, মাহবুব ভাইদের গাড়ীতে তুলে নিয়ে সোজা উত্তরা গিয়ে দুই মাইক্রোবাস একত্রিত হলো সকালের নাস্তা ও চা পাণ সেরে নিতে। এরপর যাত্রা শুরু হলো বিরিশিরি অভিমুখে।
মানুষের তুলনায় সিটের একটু সমস্যা হওয়ায় গাদাগাদি না করে, আমি আর হাসিব প্রস্তাব করলাম বাসে করে উত্তর থেকে বিরিশিরি চলে যাওয়ার। টুটুল ভাইয়ের আপত্তি এবং সকলের আশ্বাস "আরে, হয়ে যাবে..." উপেক্ষা করে আমি আর হাসিব রওনা হয়ে গেলাম বাসে করে। দুই মাইক্রোবাস দুপুরের পর পর বিকেলের আগে আগে পৌঁছে গেলেও আমি আর হাসিব উত্তরা থেকে নেত্রকোনার বাস ধরে প্রথমে এলাম নেত্রকোনা। তারপর সেখান থেকে পরিবহণ বদল করে বিরিশিরি। রাস্তা এতো বাজে যে শ’দুয়েকেরও কম পথ পাড়ি দিতে লেগেছে আট ঘণ্টার উপরে, ঝক্কোড় ঝক্কোড়.... ... .. . আর আমরা যে বাসে উঠেছিলাম, তা ছিলো সুপার লোকাল টাইপের। 
আমরা যখন বিকেলে বিরিশিরি পৌঁছলাম, তখন দলের সবাই বের হয়ে গেছে আশেপাশে ঘুরে দেখতে। আমি আর হাসিব, বিরিশিরির ভ্রমণ বাংলাদেশের পরিচিত, বাদল দা’র ‘লাকী রেস্টুরেন্ট’ এ আগে থেকে রেডি করে রাখা গরম গরম সবজী খিচুড়ি, বেগুন ভাঁজা, ছোট মাছ ভাঁজা, ডিমের কারী সাথে সালাদ, আচার দিয়ে ভরপুর "লেট লাঞ্চ" করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম........ আহ... আহ...। এখনো স্বাদ লেগে আছে মুখে। 
খাওয়া শেষে সবাই ফোন করে দলের সাথে যোগ দিলাম সরাসরি বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি'তে এসে। দুর্গাপুর গারো পাহাড়ের পাদদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত নেত্রকোনার একটি উপজেলা। সোমেশ্বরী নদীর এপারে বিরিশিরি, ওপারে দুর্গাপুর। এখানে বসবাস করে গারো, হাজং, হদি, কোচ, বানাইসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আদিবাসী। দুর্গাপুর এবং পার্শ্ববর্তী কলমাকান্দা উপজেলার আদিবাসীরা বিরিশিরিতে অবস্থিত শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই গড়ে তুলেছে এক আধুনিক নতুন পৃথিবী। তাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিক চর্চা ও সংরক্ষণ এবং জীবন মানোন্নয়নের প্রতি লক্ষ্য রেখেই ১৯৭৭সালে তৎকালীন সরকার বিরিশিরিতে উপজাতিদের জন্য একটি কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। বড় দোতলা এল সাইজের একাডেমি ভবনে রয়েছে অফিস, মিউজিয়াম, রিহার্সেল রুম, লাইব্রেরি ও অডিটোরিয়াম। 
এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম সোমেশ্বরী নদী অভিমুখে। শীতে পানি অনেক কম থাকে সোমেশ্বরীতে। তারপরও নদীর পাড়ে সূর্যাস্তের সময়টা খুবই উপভোগ্য। তবে নুড়িবালি উত্তোলনের যন্ত্র আর এর কর্কশ আওয়াজ সৌন্দর্যের বৈরাগী সুরে ব্যাতয় ঘটায়। এই নদীর পাড়ে যাওয়ার পথেই পড়বে “বিরিশিরি বধ্যভূমি”। নেত্রকোনা দূর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি এলাকায় সুমেশ্বরী নদীর তীরে বিরিশিরি বধ্যভূমি। দূর্গাপুরের বিরিশিরি বধ্যভূমিতে বৃহত্তর ময়মনসিংহের অসংখ্য মানুষকে পাক-হানাদাররা হত্যা করে। কেতাব আলী তালুকদার, আমছর মেম্বার ও হামিদ মেম্বারসহ স্থানীয় কয়েকজন দালালের সহায়তায় বিরিশিরি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের মেজর সুলতানের নেতৃত্বে এখানে হত্যাযজ্ঞ চলতো। সন্ধ্যার লালীমায় প্রকৃতি রাঙাবধূ সাঁজতে সাঁজতে হঠাৎ করেই আঁধার ঘনিয়ে এলো, ঝুপ করে সন্ধ্যা নামলো। 
এবারের দলে চারজন বছর পঁচিশের যুবক ফটোগ্রাফারের দল আমাদের সাথে ছিলো। তাঁরা সারাটা ট্রিপে চমৎকার সব ছবি তুলেছিলো। এর সাথে আমার মত শখের ভ্রমণকারীদের অন্যতম শাখা শখ ছবি তোলা তো ছিলোই। “ভ্রমণ বাংলাদেশ” এর সাথে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গিয়েছিলাম নেত্রকোনা জেলার দুরগাপুরস্থ “বিরিশিরি” ভ্রমনে। তিনদিনের সেই ভ্রমণ ছিল আড্ডা আর খুনসুটিতে ভরপুর। কিন্তু এবারকার ভ্রমণে আমার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বিরিশিরি’র আশেপাশের সকল দর্শনীয় স্পটগুলো ঘুরে দেখা। তাই বলে কি এবারো আড্ডার কমতি ছিল? মোটেই না। 
আগে থেকেই ওয়াইএমসি’র গেস্ট হাউজের সবকয়টা রুম আমাদের জন্য বুকিং দেয়া ছিল। আমি হালকা শীতের মধ্যেই গেস্ট হাউজের ঠান্ডা পানি দিয়ে সন্ধ্যের পর গোসল করলাম। লোকাল বাসে দীর্ঘ যাত্রায় ঘাম আর ধুলোবালি'তে সারা শরীর কেমন যেন আঠালো হয়ে গিয়েছিলো। গোসল শেষে একেবারে ঝরঝরে মনে হচ্ছিলো। গোসল এর পর সেই লেভেলের শীত লাগতে আরম্ভ করলে আমি টুস করে হোস্টেলের বিছানায় থাকা কম্বলের তলায় নিজেকে চালান করে দিলাম। সেখানেি এক সময় শুরু হয়ে গেল জম্পেশ আড্ডা। দলের বাকী সবাইও এক এক করে ফ্রেশ হয়ে যুক্ত হল আড্ডায়। এর মাঝে টুটুল ভাই নিয়ে এলেন গরম চা। আর যায় কোথায়, আড্ডা আরও জম্পেশ। 
রাত আটটার দিকে রুমের আড্ডা হতে তাড়া দিয়ে দলের সবাইকে খোলা আকাশের নীচে নিয়ে এলেন টুটুল ভাই। তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল বার-বি-কিউ আয়োজনের। ভ্রমণ বাংলাদেশের প্রায় ইভেন্টেই থাকে বার-বি-কিউ এর আয়োজন। আগে থেকে মশলা মাখিয়ে রাখা মাংস শিকে গাঁথা, কয়লায় আগুণ ধরানো, মাংস ঝলসানো... পুরো সময়টা কাটলো উৎসবমুখর পরিবেশে। বারিবিকিউ এর আয়োজনের পাশে সমানতালে চলতে লাগলো আড্ডা আর ছবি তোলাও। রাত সাড়ে নয়টার এর পর শুরু হল ভুঁড়িভোজ। ইচ্ছে মত ঝলসানো বার-বি-কিউ চিকেন, সাথে পরাটা-সালাদ-সফট ড্রিংকস। খাবার শেষে খোলা আকাশের নিচে চলল আড্ডা। যেনতেন আড্ডা নয়, ভুতের গল্পের আড্ডা। কয়েকজন রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো, আবার কোন কোন রুম হতে গভীর রাতেও হাসির শব্দ ভেসে আসলো। আচ্ছা ওটা কোন ভুতের আওয়াজ ছিল না তো?
 

ভ্রমণকালঃ ০৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

পরের পর্ব

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ