দুপুরের অহেতুক কালক্ষেপণের মাশুল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। দালাল বাজার পৌঁছেতেই মধ্য বিকেল। হাতে সময় অল্প, দ্রুত দালাল বাজার জমিদার বাড়ী এবং খোয়া সাগর দীঘি দেখে রওনা হলাম কামানখোলা জমিদার বাড়ী’র উদ্দেশ্যে। একটা রিকশা দেখতে পেয়ে থামালাম, আধুনিক মোটরযুক্ত রিকশা। তাকে ঠিকানা বুঝিয়ে বলতেই সে রাজী হল, কোন দরদাম না করে রিকশা স্টার্ট দিল, এদিকে সূর্য তখন ডুবে গেছে। হায় হায় সন্ধ্যা যে হয়ে গেল, এখন কি হবে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের পথ পেড়িয়ে আমায় আবার লোকাল অফিসে পৌঁছতে হবে।
এই বছরের শুরুর দিকে অফিসের কাজে গিয়েছিলাম লক্ষ্মীপুর, কাজের ফাঁকে ফাঁকে চষে বেড়িয়েছিলাম জমিদার বাড়ীর খোঁজে। দালাল বাজার জমিদার বাড়ী নিয়ে এই সিরিজেই আগে লিখেছি। অনেকদিন ধরে ঐ ভ্রমণের সময়কার অন্য দুইটি জমিদার বাড়ী নিয়ে লিখবো লিখবো করে আর লেখা হচ্ছিল না। আজ তাই লেখার চেষ্টা কামানখোলা জমিদার বাড়ী নিয়ে।
জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ।
রিকশায় বসেই আশেপাশের গ্রাম হতে মাগরিবের আজানের ধ্বনি শুনতে পেলাম। রিকশাওয়ালাকে বারবার জিজ্ঞসা করছিলাম আর কতদূর? ‘এইতো কাছেই মামা...’ তাহার প্রতিত্তর। সন্ধ্যার আলো যখন প্রায় নিভু নিভু তখন এসে পৌঁছলাম কামানখোলা গ্রামে। জমিদার বাড়ী যাওয়ার আগে একটি দীঘি চোখে পড়ল, কিন্তু আশেপাশে একটা প্রাণীরও চিহ্ন মিলল না যাকে জিজ্ঞাসা করি যে দীঘির নাম কি? যাই হোক পা বাড়ালাম জমিদার বাড়ীর দিকে।
সাদা নতুন রঙ করা এক দোতলা ভবন, একপাশে একচালা ঘর কয়েকটি, আরেক পাশে আস্তাবলের মত। প্রায় অন্ধকারে জমিদার বাড়ীর চৌহদ্দিতে প্রবেশ করলাম। কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ, আশেপাশে যেন কোন প্রাণের সাড়াশব্দ নেই। পরে বুঝতে পেরেছি আসলে গ্রামাঞ্ছলে সন্ধ্যার পর লোক চলাচল এমনিতেই কম করে, তার উপর এক পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ীর কাছে? কিন্তু ঐ সময়টায় আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম, দ্রুত দুয়েকটা ছবি তুলে রিকশায় ফিরে এলাম। রিকশাওয়ালাকে বললাম দালালবাজার ফিরে যেতে।
লক্ষ্মীপুর বাস ষ্টেন্ড থেকে সি এন জি যোগে যাওয়া যায়। রায়পুর বাস ষ্টেন্ড থেকে সি এন জি যোগে যাওয়া যায়। দালাল বাজারের কাছেই কামান খোলা জমিদার বাড়ী। জমিদার রাজেন্দ্র নাথ দাস পুত্র ক্ষেত্রনাথ দাস ও পৌত্র যদুনাথ দাস এবং যদুনাথ দাসের পৌষ্যপুত্র হরেন্দ্র নারায়ন দাস চৌধুরী পর্যায়ক্রমে জমিদারী করেন। রায়পুর উপজেলায় তাদের জমিদারী ছিল। দালাল বাজারের জমিদারদের সাথে শখ্যতা থাকায় এ জমিদারের বাড়ীর নিকটবর্তী কামান খোলায় ভূ-সম্পত্তি ক্রয় করে জমিদারী আবাস গড়ে তোলেন।
বাড়ীর সদর দরজায় খালের পাড়ের জল টংগী, লাঠিয়াল ও রক্ষী বাহিনীর আবাস, সামনে দ্বিতল লম্বা বিরাটাকারের পুজা মন্ডপ। সুরক্ষিত প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতর বাড়ীতে অপূর্ব সৌন্দর্যের রাজ প্রাসাদ। বাড়ীর অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ নৃত্য ও সালিশী কক্ষ তথা ‘আঁধার মানিক’ নামে খ্যাতে কক্ষ নিয়ে নানা মুখরোচক কাহিনী রয়েছে। হাতিমারা গেছে কিন্তু সে হাতির হাড় আছে। আছে লক্ষ্মী নারায়ন দেব বিগ্রহ। কিন্তু পোড়া কপাল, আমি এগুলোর কিছুই দেখতে পারি নাই, ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে আরেকবার যাব, এই জমিদার বাড়ীটি দেখতে।
ভ্রমণকালঃ ১০ মার্চ, ২০১৪