গত সপ্তাহে টানা দশদিনের পারিবারিক ব্যাস্ততা আর অফিসের কাজের লোড সামলে উঠতে না উঠতেই অফিস থেকে হুকুম হল অডিটের কাজে যেতে হবে লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কুমিল্লা হয়ে দাউদকান্দি। উফ, লাইফ ইজ গোয়িং টু হেল। যেহেতু কয়েকদিন পর ছুটি নিতে হবে ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ এর সাথে ‘সেন্টমার্টিন’ ট্রিপ এর জন্য, সেহেতু কোন উচ্চ-বাচ্য না করে রবিবার রাতের লঞ্চ ধরলাম লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশ্যে।
টানা দুইদিন ঝাঁ দৌড়ের উপর থেকে সব কাজ গুছিয়ে নিয়ে তৃতীয়দিন রাত যাপন করলাম কুমিল্লা’র কান্দিরপাড় এ। সকালে ফজরের পরপর ঘুম থেকে উঠে বেড়িয়ে পরলাম কুমিল্লা ডিসকভার করতে। কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।
আমি আমার ভ্রমণ শুরু করলাম ‘কুমিল্লা টাউন হল’ দিয়ে। ১৮৮৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এফ এইচ স্ক্রাইন ত্রিপুরা জেলার চাকলা রোশনাবাদের জমিদার নরেশ মহারাজ ‘বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর ’- এর কাছে পাঠাগার তৈরীর নিমিত্ত জমি প্রদানের অনুরোধ জানান । মহারাজ কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমির উপর একটি ভবন নিজস্ব অর্থায়নে করে দেন। ১৮৮৫ হালড় ৬ মে প্রতিষ্ঠিত ওই ভবনই কুমিল্লার গনপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন, যা কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত। বর্তমানে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি পরিচালনা পরিষদ টাউন হল পরিচালনা করে। বর্তমানে এর সাধারণ সদস্য সংখ্যা এক হাজার। টাউন হলে দুটি বিভাগ রয়েছে। একটি গণপাঠাগার, অন্যটি নগর মিলনায়তন। এ টাউন হলে পদধূলি দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরো অনেক মনীষি ।
এখান হতে চলে আসলাম ‘ধর্ম সাগর দীঘি’র পাড়ে, সূর্যোদয় দেখতে। ধর্মসাগর কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত প্রাচীন দিঘি। ত্রিপুরারা অধিপতি মহারাজা প্রথম ধর্মমাণিক্য ১৪৫৮ সালে ধর্মসাগর খনন করেন। এই অঞ্চলের মানুষের জলের কষ্ট নিবারণ করাই ছিল রাজার মূল উদ্দেশ্য। “রাজমালা” গ্রন্থ আনুসারে মহারাজা সুদীর্ঘ ৩২ বছর রাজত্ব করেন (১৪৩১-৬২ খ্রিষ্টাব্দ)। মহারাজা ধর্মমাণিক্যের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় ধর্মসাগর। ধর্মসাগর নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহু উপাখ্যান ও উপকথা।
২৩:১৮ একর আয়তনের ধর্মসাগরের উত্তর কোণে রয়েছে রাণীর কুঠির, পৌরপার্ক। পূর্ব দিকে কুমিল্লা জিলা স্কুল, কুমিল্লা স্টেডিয়াম আর পশ্চিম পাড়ে বসার ব্যবস্থা আছে। স্থানীয় অধিবাসী ছাড়াও পর্যটকের আগমন ঘটে। দিঘিপাড়ের সবুজ বড় বড় গাছের সারি ধর্মসাগরকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। তাছাড়াও শীতকালে ধর্মসাগরে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটে। ধর্মসাগরে সূর্যোদয় দেখে উত্তরকোনে অবস্থিত রানীকুঠির দেখে রওনা হলাম কুমিল্লা’র বার্ড তথা ‘বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী’ দেখতে।
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী বা বার্ড, বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনস্থ একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তথা পল্লীর দারিদ্র্য বিমোচনে নিরলস সহায়তা করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি কুমিল্লা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে কোটবাড়ীতে অবস্থিত।
বার্ড ১৯৫৯ সালের ২৭শে মে তৎকালীন সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত বিএইড(VAID) প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গ্রামের অবহেলিত জনমানুষের সমস্যাসহ গ্রামের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান গ্রাম উন্নয়ন একাডেমী নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে নেতৃত্ব দেন প্রখ্যাত পল্লী উন্নয়ন গবেষক, দার্শনিক ও সমাজসেবক ড. আখতার হামিদ খান। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান নামে নামান্তরিত হয়।
বার্ড এর সাজানো সবুজের সমারোহে প্রায় ঘণ্টা খানেকে একাকী আনমনে পায়ে হাঁটা আর প্রকৃতির সুধাপানে খুব সুন্দর সময় কাটালাম। মাঝে মাঝে একাকীত্বও বুঝি খুব মধুর হয়।
বার্ড থেকে বাহির হয়ে একটু এগিয় গিয়ে রাস্তার দুইধারে দেখলাম দুই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘রূপবান মুড়া’ আর ‘ইটাখোলা মুড়া’।
কুমিল্লার প্রাচীন উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থানসমূহের মধ্যে রূপবান মুড়া অন্যতম। এ স্থানটি দেখতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ভিড় করে এখানে। কুমিল্লা-কালিরবাজার সড়কের দক্ষিন পার্শ্বের কোটবাড়ী এলাকায় ভূমি থেকে প্রায় ৪০ ফুট উঁচুতে এটি অবস্থিত।
কুমিল্লা শহর থেকে বাস, ট্যাক্সি অটোরিকশা, মাইক্রো কিংবা রিকশা দিয়ে যাওয়া যায় এই রূপবান মুড়াতে। রূপবান মুড়াতে সর্বপ্রথম খননকার্য শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। পরবর্তীতে ১৯৮৪, '৮৫ এবং '৮৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এখানে আরও তিন দফা খনন কাজ করে। এখানকার মন্দিরটিকে বিহারের বাইরে আলাদা স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে মন্দিরটি ঐতিহ্যগতভাবে চতুর্মুখী ও বর্গাকৃতি ভূমি নকশায় নির্মিত এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে একে ক্রুশাকৃতির রূপ দেয়া হয়। রূপবান মুড়ায় প্রত্নতাত্তি্বক খননের ফলে একটি বিহার, একটি মন্দির, একটি ৰুদ্র স্তুপ ও একটি উচ্চ মঞ্চের স্থাপত্য নিদর্শন উন্মোচিত হয়। এ নিদর্শনগুলোর মধ্যে তিন আমলের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মূল নির্মাণসামগ্রী ছিল ইট ও কাদা।
রূপবান মুড়ার প্রায় মাঝামাঝি অংশে একটি পূর্বমুখী প্রাচীরঘেরা চত্বরের পশ্চিম অংশজুড়ে মন্দিরটির অবস্থান। এর পিছনের অংশটি মূর্তি কোঠা এবং সামনের অংশটি ম-প। ম-পে বাতি জ্বালিয়ে রাখার জন্য খোপ ছিল। প্রতিটি মূর্তি কোঠায় একটি করে দেবীও ছিল। পূর্ব দিকের মূর্তি কোঠাটি পাশাপাশি তিনটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। একটি প্রকোষ্ঠে একটি বেলে পাথরের তৈরি দণ্ডায়মান বৌদ্ধমূর্তি ছিল। মন্দিরটির চারদিক প্রথমে প্রদক্ষিন পথ ও পরে প্রাচীর দিয়েও ঘেরা ছিল।
রূপবান মুড়ায় পাওয়া পুরা বস্তুর মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির ফলক, অলঙ্কৃত ইট, খাদ মিশ্রিত সোনায় তৈরি পাঁচটি গুপ্ত অনুকৃত মুদ্রা, একটি ব্রোঞ্জের হাতল, ত্রিশূল ও লিপিসহ তিনটি রৌপ্য মুদ্রা, একটি ধাতব শিতাতপত্র, একটি ধাতব অমিতাভ, লোহার পেরেক, ধাতব মুদ্রার টুকরা ইত্যাদি।
এই ইমারত থেকে প্রায় ৫০ গজ দৰিণ-পূর্ব দিকে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা প্রায় একটি ইমারতের ধ্বংসাবশেষ আছে। এই ইমারতের চারদিকে অসংখ্য ইষ্টক নির্মিত স্তম্ভ ছিল। এগুলোর নিচের অংশ এখনও টিকে আছে।
সম্ভবত এটি একটি হলঘর এবং মাঝের ইমারতটি ছিল একটি বৌদ্ধমন্দির বা সত্মূপ। রূপবান মুড়ায় এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ও প্রত্নপ্রমাণের বিচারে প্রথম যুগের মন্দির ও বিহার খ্রিস্টীয় ৮ম-শতাব্দীর পূর্বে নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়।
ইটাখোলা মুড়ায় বেশ কয়েকবার খননকাজ চালিয়ে বড় বড় কিছু বৌদ্ধস্তূপ ও এসব স্তূপ থেকে ৪২ মিটার উত্তরে সংলগ্ন একটি বৌদ্ধ মঠের সন্ধানও পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, এই প্রত্নস্থানটিকে পাঁচটি সাংস্কৃতিক যুগ অতিক্রম করতে হয়েছে। পূর্ববর্তী তিন সাংস্কৃতিক কালপর্যায়ের নির্দশনগুলো পরবর্তীকালের ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে।
এজন্য সব নিদর্শনগুলো উদ্ধার করা সহজ হচ্ছেনা। এই স্থানের মূল আকর্ষণ বিস্তীর্ণ স্তূপ কমপ্লেক্স। ১৩.১ বর্গমিটার ভিতের উপর অবস্থিত এই স্তূপটি নিরেটভাবে নির্মিত। স্তূপের পূর্ব বা সম্মুখভাগের মধ্যস্থলে একটি ক্ষুদ্র পীঠস্থান রয়েছে যার আকৃতি ২.৪ মি. এবং ২.১ মি.।
ইটাখোলা মুড়া থেকে বেড়িয়ে এগিয়ে গেলাম ময়মামতি বিহারের দিকে। ময়নামতি বাংলাদেশের কুমিল্লায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান। এযাবৎ আবিষ্কৃত লালমাই অঞ্চলের প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন হল ময়নামতি প্রত্নস্থল। বর্তমানে ময়নামতি অঞ্চলে যে ধ্বংশস্তুপ দেখা যায় তা প্রকৃতপক্ষে একটি প্রাচীন নগরী ও বৌদ্ধ বিহারের অবশিষ্টাংশ । প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে ইহা জয়কর্মান্তবসাক নামক একটি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ ।
শালবন বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুমিল্লা জেলার লালমাই-ময়নামতি প্রত্নস্থলের অসংখ্য প্রাচীন স্থাপনাগুলোর একটি এই বৌদ্ধ বিহার । এটি ১২শ প্রত্নতাত্বিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।
কুমিল্লার ময়নামতিতে খননকৃত সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে শালবন বিহার অন্যতম প্রধান। বিহারটির আশপাশে এক সময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে এ বিহারটির নামকরণ হয়েছিল শালবন বিহার। এর সন্নিহিত গ্রামটির নাম শালবনপুর। এখনো ছোট একটি বন আছে সেখানে।
এ বিহারটি পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মতো হলেও আকারে ছোট। ধারণা করা হয় যে খৃষ্টিয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন।
শালবন বিহারের ছয়টি নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ পর্বের কথা জানা যায়। খৃষ্টিয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় মন্দিরটি নির্মাণ করা হয় ও বিহারটির সার্বিক সংস্কার হয় বলে অনুমান করা হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের নির্মাণকাজ ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয় নবম-দশম শতাব্দীতে।
আকারে এটি চৌকো। শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারের চার দিকের দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। কক্ষগুলো বিহারের চার দিকের বেষ্টনী দেয়াল পিঠ করে নির্মিত। বিহারে ঢোকা বা বের হওয়ার মাত্র একটাই পথ ছিল। এ পথ বা দরজাটি উত্তর ব্লকের ঠিক মাঝামাঝি স্খানে রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের মাঝে ১.৫ মিটার চওড়া দেয়াল রয়েছে। বিহার অঙ্গনের ঠিক মাঝে ছিল কেন্দ্রীয় মন্দির।
বিহারে সর্বমোট ১৫৫টি কক্ষ আছে। কক্ষের সামনে ৮.৫ ফুট চওড়া টানা বারান্দা ও তার শেষ প্রান্তে অনুচ্চ দেয়াল। প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে তিনটি করে কুলুঙ্গি রয়েছে। কুলুঙ্গিতে দেবদেবী, তেলের প্রদীপ ইত্যাদি রাখা হতো। এই কক্ষগুলো ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। সেখানে বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মচর্চ্চা করতেন।
বিহারের বাইরে প্রবেশ দ্বারের পাশে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি হলঘর রয়েছে। চার দিকের দেয়াল ও সামনে চারটি বিশাল গোলাকার স্তম্ভের ওপর নির্মিত সে হলঘরটি ভিক্ষুদের খাবার ঘর ছিল বলে ধারণা করা হয়। হলঘরের মাপ ১০ মিটার গুণন ২০ মিটার। হলঘরের চার দিকে ইটের চওড়া রাস্তা রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে আটটি তাম্রলিপি, প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিলমোহর, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে। এগুলো বাংলাদেশের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করছে।
বিহার থেকে বেড়িয়ে রিকশা এবং পরে বাসে করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে অপর প্রান্তে অবস্থিত কুমিল্লা’র ওয়ার সিমেট্রি দেখতে চলে এলাম। ময়নামতি রণ সমাধিক্ষেত্র মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) নিহত ভারতীয় (তৎকালীন) ও বৃটিশ সৈন্যদের কবরস্থান। এটি ১৯৪৩-১৯৪৪ সালে তৈরি হয়েছে। ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি বাংলাদেশের কুমিল্লাতে অবস্থিত একটি কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি। ১৯৪১-১৯৪৫ সালে বার্মায় সংঘটিত যুদ্ধে যে ৪৫০০০ কমনওয়েলথ সৈনিক নিহত হন, তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে মায়ানমার (তৎকালীন বার্মা), আসাম, এবং বাংলাদেশের ৯টি রণ সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে দুটি কমনওয়েলথ রণ সমাধিক্ষেত্র আছে, যার অপরটি চট্টগ্রামে অবস্থিত। প্রতিবছর প্রচুর দর্শনার্থী যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের প্রতি সম্মান জানাতে এসকল রণ সমাধিক্ষেত্রে আসেন।
কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের খুব কাছেই এই যুদ্ধ সমাধির অবস্থান। এই সমাধিক্ষেত্রটি Commonwealth War Graves Commission (CWGC) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ও তারাই এই সমাধিক্ষেত্র পরিচালনা করেন। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে সকল ধর্মের ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে এখানে একটি বার্ষিক প্রার্থণাসভা অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লায় তৎকালীন সময়ে ছিল অনেক বড় হাসপাতাল। এছাড়া কুমিল্লা ছিল যুদ্ধ-সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্র, বিমান ঘাঁটি, আর ১৯৪৪ সালে ইম্ফলে স্থানান্তরিত হবার আগে চতুর্দশ সেনাবাহিনীর সদরদপ্তর।
এই সমাধিক্ষেত্রের ৭৩৬টি কবর আছে। এর মধ্যে অধিকাংশ হলেন সেসময়কার হাসপাতালের মৃত সৈনিকরা। তাছাড়াও যুদ্ধের পর বিভিন্ন স্থান থেকে কিছু লাশ স্থানান্তর করেও এখানে সমাহিত করা হয়। বাহিনী অনুযায়ী এখানে এর মধ্যে রয়েছেন ৩জন নাবিক, ৫৬৭জন সৈনিক এবং ১৬৬জন বৈমানিক। সর্বমোট ৭২৩ জন নিহতের পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছিল। সমাধিক্ষেত্রটির প্রবেশমুখে একটি তোরণ ঘর, যার ভিতরের দেয়ালে এই সমাধিক্ষেত্রে ইতিহাস ও বিবরণ ইংরেজি ও বাংলায় লিপিবদ্ধ করে একখানা দেয়াল ফলক লাগানো রয়েছে। ভিতরে সরাসরি সামনে প্রশস্থ পথ, যার দুপাশে সারি সারি কবর ফলক।
সৈন্যদের ধর্ম অনুযায়ী তাদের কবর ফলকে নাম, মৃত্যু তারিখ, পদবির পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক লক্ষ করা যায়- খ্রিস্টানদের কবর ফলকে ক্রুশ, মুসলমানদের কবর ফলকে আরবি লেখা (যেমন: হুয়াল গাফুর) উল্লেখযোগ্য।
প্রশস্থ পথ ধরে সোজা সম্মুখে রয়েছে সিঁড়ি দেয়া বেদি, তার উপরে শোভা পাচ্ছে খ্রিস্টধর্মীয় পবিত্র প্রতীক ক্রুশ। বেদির দুপাশে রয়েছে আরো দুটি তোরণ ঘর। এসকল তোরণ ঘর দিয়ে সমাধিক্ষেত্রের পিছন দিকের অংশে যাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে আরো বহু কবর ফলক। প্রতি দুটি কবর ফলকের মাঝখানে একটি করে ফুলগাছ শোভা পাচ্ছে।
এছাড়া পুরো সমাধিক্ষেত্রেই রয়েছে প্রচুর গাছ। সমাধিক্ষেত্রের সম্মুখ অংশের প্রশস্থ পথের পাশেই ব্যতিক্রমী একটি কবর রয়েছে, যেখানে একসাথে ২৩টি কবর ফলক দিয়ে একটা স্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই স্থানটি ছিল মূলত ২৩ জন বিমানসৈনিকের একটি গণকবর, যেখানে লেখা রয়েছে: These plaques bear the names of twenty three Airmen whose remains lie here in one grave।
কুমিল্লার ভ্রমণ ওয়ার সিমেট্রি দিয়ে শেষ করে রওনা হলাম দাউদকান্দির উদ্দেশ্যে। আসার সময় সাথে নিয়ে আসলাম আদি ‘মাতৃভাণ্ডার’ (৩৪৩, মনোহরপাড়া – কালীবাড়ির বিপরীতে) থেকে কয়েক কেজি রসমলাই, বন্ধু-বান্ধব আর বাসার সবার জন্য। সাথে বোনাস ছিল মেঘনা সেতু থেকে শেষ লগ্নের সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য। শেয়ার করলাম আপনাদের সাথে, এইতো... .. .
ভ্রমণকালঃ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪