বালাপুর জমিদার বাড়ি - নরসিংদী (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ২৩)

২০২১ সালের শেষ দিনে আমরা কয়েকজন বন্ধু স্বপরিবারে গিয়েছিলাম আড়াইহাজার বেড়াতে, উদ্দেশ্য রাতে বারবিকিউ আর আড্ডা; সকালে সর্ষের মাঝে ভূত খোঁজা, ;) থুক্কু সর্ষে ক্ষেতে ভ্রমণ। বেলা এগারোটা নাগাদ সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও আমি রয়ে যাই আশেপাশের কিছু জমিদার বাড়ি দর্শনের উদ্দেশ্যে। আগের এক পর্বে বলেছিলাম সদাসদী জমিদার বাড়ী'র গল্প। আজ চলুন ঘুরে দেখি বালাপুর জমিদার বাড়ি। 

ভ্রমণ বন্ধু, ব্লগার সাদা মনের মানুষ, কামাল ভাইয়ের বাড়ি নরসিংদী। বন্ধু মনার মাধ্যমে জানতে পারলেন আমি আছি নরসিংদী। ফোন করলেন দেখা করতে। দুপুরের পর বিকেলবেলা কামাল ভাইয়ের গাড়ী নিয়ে তুহিন ভাই সহ বের হলাম দুটি জমিদার বাড়ি দেখতে। তার একটি ছিলো বালাপুর জমিদার বাড়ি। শেষ বিকেলে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখে যথারীতি হতাস হতে হলো। জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে দুঃখ হয়, কিভাবে অবহেলায় এসব নিদর্শন হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ।

কামাল ভাইয়ের সাথে "সাতগ্রাম জমিদার বাড়ি" হতে ফেরার সময় জানলাম মাধবদীতেই আছে আরেকটা জমিদার বাড়ী, নাম "বালাপুর জমিদার বাড়ী"। সূর্যাস্ত'র আধঘণ্টা মত বাকী ছিল। কামাল ভাই এর ড্রাইভিং এবং রুট পরিচিত হওয়ার কল্যাণে সন্ধ্যা হওয়ার মিনিট দশেক আগে গিয়ে পৌঁছলাম বালাপুর। কিন্তু বিধিবাম, ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জ একেবারে শুন্য... বিকেলবেলা কামাল ভাইয়ের অফিসে মোবাইল চার্জ দিলেও ক্যামেরার ব্যাটারির কথা মনে ছিলো না। তো কি আর করার, লো রেজুলেশন এর মোবাইল ক্যামেরা দিয়েই কিছু ছবি তুলে নিলাম।

নরসিংদীর শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে, শান্ত গ্রাম বালাপুর। এই গ্রামের বুকেই দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন নিদর্শন— বালাপুর জমিদার বাড়ি। চারপাশে সবুজ ফসলের মাঠ, পুরনো গাছপালা আর গ্রামের মায়াময় নিস্তব্ধতার মধ্যে এই বাড়িটি যেন ইতিহাসের এক নির্বাক প্রহরী— সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

বালাপুর জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা বাবু নবীনচন্দ্র সাহা। তবে কবে নাগাদ এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয় তা জানা যায়নি। প্রায় ৩২০ বিঘা জমির উপর এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। এখানে একটি একতলা ভবন, একটি দোতালা ভবন ও একটি তিনতলা ভবন তৈরি করা হয়েছিল যা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। জমিদার বাবু নবীনচন্দ্র ছিলেন সংস্কৃতিমনা। সন্ধ্যা নামলেই জমিদার বাড়িতে প্রতিদিন ডাক ঢোলের বাজনা বাজা শুরু হত। বিভিন্ন ধরনের নাটক, পালা গানসহ আরো অনেক ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হলে তারা তাদের জমিজমা মন্দিরের নামে উইল করে দিয়ে এই দেশ ছেড়ে চলে যান।

৩২০ বিঘা জমির উপর একটি একতলা, একটি দুইতলা ও একটি তিনতলা ভবন রয়েছে। তিনতলা ভবনটি একশত এক (১০১) কক্ষ বিশিষ্ট ভবন। ৯২ শতক জমি জুড়ে একটি পুকুর রয়েছে। পুকুরটিতে পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা ঘাট রয়েছে। এছাড়াও একটি দুর্গাপূজার মণ্ডপ রয়েছে। আর জমিদার বাড়ীর পাশেই দেখতে পেলাম ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী বালাপুর নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। বর্তমানে বাড়ীটির বেশীরভাগ অংশে নতুন স্থাপনা গড়ে উঠেছে; আর জমিদার বাড়ীর অবশিষ্টাংশ যা রয়েছে; তার অবস্থাও জরাজীর্ণ ভগ্নাবস্থায়।

বালাপুর জমিদার বাড়ি কেবল একটি বাসভবন নয়, এটি ছিল রাজকীয় মর্যাদার প্রতীক। তিনতলা বিশিষ্ট মূল ভবনটির সম্মুখভাগে ছিল উঁচু স্তম্ভ, বিশাল খিলানযুক্ত বারান্দা এবং অলঙ্কৃত রেলিং। দেয়ালে রঙিন মোজাইক ও ফুলেল নকশা, ছাদের নিচে কাঠের কড়িকাঠে সূক্ষ্ম খোদাই— সব মিলিয়ে বাড়িটি এক শিল্পকর্মের মতোই মনে হয়।

বাড়িটির কেন্দ্রভাগে ছিল দোতলার নাচঘর, যেখানে ব্রাহ্মণ সংগীতজ্ঞরা রাজপরিবারের অতিথিদের সামনে পরিবেশনা করতেন। পাশে ছিল ‘অন্দরমহল’, যেখানে জমিদার পরিবারের নারীরা থাকতেন। বাড়ির দক্ষিণ অংশে ছিল একটি ছোট মন্দির, যেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা চলতো। বালাপুর জমিদার বাড়ি শুধু শাসনের কেন্দ্র ছিল না— এটি ছিল স্থানীয় সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্রও। জমিদার পরিবার স্কুল স্থাপন, দান-খয়রাত ও উৎসবের মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

দুর্গাপূজা, দোলযাত্রা, বা নবদ্বীপের রাস উৎসব— প্রতিটি অনুষ্ঠানেই দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে অংশ নিত। জমিদার বাড়ির উঠোনে সেই সময় বাজত ঢাক-ঢোল, আলোকসজ্জায় ঝলমল করত সমগ্র এলাকা। ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে ‘পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট’-এর অবসান ও জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বালাপুর জমিদার পরিবারের প্রভাবও হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৫০ সালের জমিদারি প্রথা বিলোপ আইনের পর তাঁদের জমির অধিকাংশই সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। ধীরে ধীরে রাজপরিবারের সদস্যরা কলকাতা, ঢাকা বা বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বাড়িটি পড়ে থাকে অবহেলায়, সময়ের আঘাতে ভেঙে যেতে থাকে এর প্রাচীর, ছাদ ও দরজা-জানালা।

বর্তমানে বালাপুর জমিদার বাড়ির মূল ভবনটির একটি অংশ এখনো টিকে আছে। অনেক কক্ষ ভেঙে পড়েছে, কিছু জায়গায় স্থানীয় পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। পুরনো ইটের দেয়ালে গাছের শিকড় গেঁথে আছে— যেন প্রকৃতি তার অধিকার ফিরে নিচ্ছে।




মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ