কম খরচে (১,৫০০ টাকায়) ঘুরে আসুন কলমাকান্দা-পাঁচগাঁও-লেঙ্গুরা


অনেকদিন হলো "কম খরচে ঘোরাঘুরি" নিয়ে কিছু লেখি না। কারণ, একে তো ঘোরাঘুরি কমতে কমতে চলে গেছে তলানিতে; তার উপর বেশি লিখতাম "ভারত ভ্রমণ" নিয়ে, যা ২০২২ এর পরে বন্ধ আছে। তো, গতকাল নেত্রকোনা'র কলমাকান্দা ➤ পাঁচগাঁও ➤ লেঙ্গুরা ঘুরে আসার পরে অনেকেই এই ভ্রমণ নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। গ্রুপ ট্যুর নিয়ে অনেক পোস্ট পাবেন অথবা ভিডিও। আমি বরং আমার অভিজ্ঞতা বলি। বাজেট ট্যুর মানেই কিন্তু কম খরচে ভ্রমণ নয়। আমি ভারতে প্রতিদিন ১০ হাজার রুপীর বেশী খরুচে ট্যুর যেমন দিয়েছি, তেমনি দৈনিক ১২০০ রুপীতে সকল খরচ ম্যানেজ করা ট্যুরও দিয়েছি। মূল বিষয় আপনার মিনিমাম কমফোর্ট লেভেল এবং ভ্রমণ আনন্দের পূর্ণতা ও স্বাচ্ছন্দ; এই দুইয়ের সমন্বয় করা। তো আসুন আমার নেত্রকোনা'র কলমাকান্দা ➤ পাঁচগাঁও ➤ লেঙ্গুরা ভ্রমণের সামারি করা যাক। 

১ম দিন: রাতের ট্রেনে যাত্রা করুন। "হাওর এক্সপ্রেস" ঢাকা থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার শিডিউল টাইম ১০:১৫ মিনিট হলেও ট্রেন লেট করে ছাড়ে প্রায় নিয়মিতই। ট্রেন থামবে ঢাকা বিমানবন্দর, জয়দেবপুর জংশন, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ জংশন, গৌরীপুর জংশন, শ্যামগঞ্জ জংশন, নেত্রকোণা, ঠাকুরাকোণা এবং সবশেষে মোহনগঞ্জ। সমস্যা বেশীরভাগ স্টেশনেই যাত্রাবিরতি একটু দীর্ঘ হয়,  পুরো ট্রেনের ইলেক্ট্রিসিটি অফ করে দেয়। প্রচুর লোকাল লোকজন উঠে। এসব সইতে পারলে মন্দ হবে না। ১৯০ টাকার শোভন শ্রেণীর টিকেট যা অনলাইনে ২১০ টাকা নিলেও বেশী সিট এভেইলেবল দেখি নাই। তাই এসব ঝামেলা এড়াতে চাইলে ঢাকার মহাখালী হতে নেত্রকোনা বা কলমাকান্দা বা পাঁচগাও এর রাতের বাসে রওনা হয়ে যেতে পারেন। এখন পাঁচগাও রুটেও বাস আছে। ভাড়া ৪০০ টাকার আশেপাশেই। আমি পছন্দ করেছিলাম যে রুট: ঢাকা-ঠাকুরাকোণা-কলমাকান্দা-পাঁচগাও-লেঙ্গুরা-নেত্রকোণা-ঢাকা। চাইলে লেঙুরা হতে দূর্গাপুর-বিরিশিরি হয়ে ঢাকা ব্যাক করার প্ল্যান করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সাইটসিয়িং এর ট্রান্সপোর্ট অবশ্যই বিরিশিরি বা নেত্রকোণা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত নিবেন কমপক্ষে। 

২য় দিন: ভোররাত চারটার আশেপাশে পৌছে যাবেন ঠাকুরাকোনা। রেলস্টেশনের বাইরে এই শেষ রাতের দিকেই পেয়ে যাবেন শেয়ারড সিএনজি এবং অটোরিকশা। সব যাত্রী বের হয়ে গেলে সেখানে আর কোন যানবাহন থাকবে না। আমি এই কাজ করেছিলাম এবং স্টেশনের বাইরে একটা বেড়ার হোটেলে বসে বসে আলো ফোঁটার অপেক্ষা করছিলাম। ফজরের আজানের পরপর স্টেশন থেকে বের হয়ে মেইনরোডে এসে হাতের ডানদিক ধরে মিনিট দশেকের কম হাঁটলে পৌঁছে যাবেন দেউলি, বারহাট্টা এলাকার ধনাইখালি নদীর উপর ঠাকুরাকোনা ব্রিজের অপর মাথায়। ব্রিজের উপর হতে ভোরের প্রথম আলোর রূপের হাতছানিতে থমকে দাঁড়াতে পারেন কিছু সময়ের জন্য। এর আগে পথেই সেরে নিতে পারেন ফজরের নামাজ, মসজিদ হতে আজানের আওয়াজ পাবেন, দেখা মিলবে নামাজীদের মসজিদে যাওয়ার পথে। 

নামাজ শেষে ব্রিজের অপর মাথায় এসে শেয়ারড সিএনজি পেয়ে যাবেন জনপ্রতি ৮০-১০০ টাকা ভাড়ায়। ৫ জনের দল হলে ৪০০ টাকায় রিজার্ভ করে নিতে পারবেন কলমাকান্দা পর্যন্ত, ৮০০-১০০০ টাকায় পাঁচগাঁও। সারাদিনের জন্য লেঙ্গুরা পর্যন্ত ২০০০-২৫০০ টাকা আর দূর্গাপুর পর্যন্ত হাজার চারেক নিতে পারে, এটার খোঁজ নেই নাই। আমি কলমাকান্দা থেকে পাঁচগাঁও এর চন্দ্রডিঙ্গা-পাতলাবন-মোমিনের টিলা হয়ে লেঙ্গুরা সাত শহীদের মাজার পর্যন্ত ঘুরে কলমাকান্দা ব্যাক করেছিলাম ৮০০ টাকা ভাড়ার মোটরসাইকেল দিয়ে যা দূর্গাপুরের চিনামাটির পাহাড়, জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ঘুরিয়ে বিরিশিরি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত নিবে ১৫০০ টাকায়।

এবার ভ্রমণ সময়সূচি নিয়ে বলি। নেত্রকোনা অঞ্চলের গরম আমার প্রতিবারই ভালো লাগে না, গায়ে জ্বালা করে, সহ্য হয় না। তাই খুব ভোরে যাত্রা শুরু করলে প্ল্যান এমন করুন:

ভোর ৬:০০-০৭:৩০টা ⇨কলমাকান্দা টু পাঁচগাঁও এর চন্দ্রডিঙ্গা যাত্রা এবং ঘুরে দেখা।

সকাল ৭:৩০-০৯:০০টা ⇨ চন্দ্রডিঙ্গা টু পাতলাবন ভায়া গনেশ্বর নদী পারাপারে জলে পা ভিজিয়ে নদীর তীরে ঘুরে নিতে পারেন। পাতলাবন ঘুরে দেখা।

সাথে রুটি-কলা জাতীয় খাবার রাখুন নাস্তার জন্য, এই প্ল্যানের রুটে ভালো খাবার হোটেল নাই। চন্দ্রডিঙ্গা স্পটে কিছু খাবারের দোকানেও নাস্তা করতে পারেন। মোমিনের টিলা বা পাতলাবন এর কাছাকাছিও লোকাল খাবার হোটেলে নাস্তা করে নিতে পারেন। তবে ভালো চা কোনটায় পাই নাই একমাত্র কলমাকান্দা বাসস্ট্যান্ডের চায়ের দোকানেরটা ছাড়া, খুব জমজমাট এবং দুধের মালাই দেয়া চা ১০টাকা কাপ। আমি যাওয়া এবং আসার পথে দু'বার এই চায়ের স্বাদ নিতে ভুলি নাই।

সকাল ০৯:০০-১১:০০টা ⇨ পাতলাবন টু মোমিনের টিলা পৌঁছানো এবং ঘুরে দেখা এবং লেঙ্গুরা সাত শহীদের মাজার ভ্রমণ শেষে কলমাকান্দার উদ্দেশ্যে রওনা।

বেলা ১১:০০-১২:০০টা ⇨কলমাকান্দা পৌঁছে এককাপ মালাই চা পাণ করে নেত্রকোনার উদ্দেশ্য যাত্রা।

হাতে সময় বেশী থাকলে নিজের মতো করে রিলাক্স মুডে চারটি স্পটই ঘুরে দেখতে পারেন। সন্ধ্যার পর নেত্রকোনা ব্যাক করে রাত ৭/৮ টার গাড়ীতে ঢাকা রওনা হলে রাত ১২টার মধ্যে ঢাকা পৌঁছে যাবেন ইনশাআল্লাহ কোন অস্বাভাবিক ট্রাফিক জ্যাম না থাকলে।

অক্টোবর-ডিসেম্বর সেরা সময় এই জায়গা ভ্রমণের জন্য। গাছের সবুজ আলপনা মুছে যাওয়ার আগেই এখানে ভ্রমণ উত্তম। 

বেলা ১২:০০-দুপুর ০২:০০টা ⇨ কলমাকান্দা হতে নেত্রকোনা রওনা শেয়ারড সিএনজি করে, ভাড়া ১২০ টাকা, ঢাকা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ১৪০ টাকা জনপ্রতি। দেড়টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন। নামাজ এবং দুপুরের খাবার শেষ করুন এই সময়ে।

দুপুর ০২:৩০-সন্ধ্যা ০৬:৩০টা ⇨ নেত্রকোনা টু ঢাকা বাস যাত্রা। রাস্তা ভালো, অস্বাভাবিক জ্যাম না থাকলে ৪ ঘন্টায় উত্তরা পৌঁছে যাবেন। আমি হাউজবিল্ডিং নেমে মেট্রোরেল করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টেশনে আসছি, ১ঘন্টার মধ্যে; সবমিলিয়ে ৫ ঘন্টার মধ্যে নিজ এলাকায় পৌঁছে গেছিলাম।  

মোট খরচ:

➤ ঢাকা নিজ বাসা হতে কমলাপুর/বিমানবন্দর স্টেশন যাতায়াত ১৫০টাকা। ট্রেন টিকেট ২১০টাকা। চা নাস্তা হালকা ট্রেনে হকার থেকে কিছু খেতে পারেন, আপনার রুচিসম্মত মনে হলে। সর্বমোট ৪০০ টাকা বরাদ্দ রইলো। বাস ভাড়াও এমনই।

➤ ঠাকুরাকোনা টু কলমাকান্দা, কলমাকান্দা টু নেত্রকোনা শেয়ারড সিএনজি ২৫০ টাকা।

➤ রিজার্ভ মোটরসাইকেল ৮০০টাকা। আমি ভাড়া করেছিলাম আব্দুস সালামকে, ভালো ছেলে, কল করে বুকিং দিতে পারবেন এই নম্বরে 01915283955

➤ সকালের নাস্তা, দুপুরের লাঞ্চ, পানি এবং চা (১০০+১৫০+৫০+৫০) ৩৫০ টাকা।

➤ নেত্রকোনা টু ঢাকা ৪০০ টাকা। বাস "রফরফ পরিবহন" নিয়মিত আধঘন্টা পরপর বাস। ভাটিবাংলা সহ অন্যান্য বাস জায়গায় জায়গায় থেমে যাত্রী উঠায়, সময় ঘন্টা দুয়েক বেশীও যায় অনেক সময়।

➤➤➤ মোট খরচ ২,২০০ টাকা। ৫ জনের গ্রুপ হলে ১,৫০০ টাকা জনপ্রতি খরচে ঘুরে আসতে পারবেন একদিনের ছুটিতে বা শুক্রবার এর বন্ধে। 

আর বেলা ১১:০০টায় দূর্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে বিকেলের মধ্যে বিরিশিরির চিনামাটির পাহার, জিরোপয়েন্ট, সোমেশ্বরী নদী, রানীখং গির্জা, এবং কমলা রানীর দিঘী দেখা শেষ করুন বিকেলের মধ্যে এবং ধরুন ঢাকার বাস। চাইলে থাকতে পারেন রাতে; আছে হোটেল এবং রেস্টহাউজ। উল্লেখযোগ্য কিছুর তালিকা নীচে দিয়ে দিলাম।

 ১। জেলা পরিষদ ডাক বাংলো

   মোবাইল: 01558380383, 01725571795

.

২। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী গেস্ট হাউজ

     ফোন: 0952556042, মোবাইল: 01815482006

.

৩। দূর্গাপুর ডাক বাংলো, দূর্গাপুর।

    ফোন: 0952556015

.

এই তিনটি সরকারি আবাসনে রাত্রীযাপন করতে গেলে ভাড়া পড়বে রুমপ্রতি ৩০০-৫০০ টাকা

.

৪। ইয়ুথ মেন খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইএমসিএ -এর রেস্ট হাউজ।

   মোবাইল- 01818613496, 01716277637, 01714418039, 01743306230, 01727833332, 01924975935

.

৫। YWCA গেস্ট হাউজ

     মোবাইল – 01712042916, 01711027901

.

উপজাতীয় সংগঠন পরিচালিত এই দুইটি আবাসনে রাত্রীযাপন করতে চাইলে ভাড়া পড়বে রুমপ্রতি ৫০০-৮০০ টাকা।

.

৬। স্বর্ণা গেস্ট হাউজ

     দুর্গাপুর বাসস্ট্যান্ডের সাথে

     মোবাইল: 01712228698, 01728438712, 01748964322

.

৭। হোটেল নিরালা

     বিরিশিরি বাসস্ট্যান্ড থেকে ২ কি.মি. উত্তরে

     মোবাইল: 01712786798

.

৮। হোটেল সুসং

     মোবাইল: 01914791254

.

৯। আমাদের বাড়ি রিসোর্ট

    বিজয়পুর সাদা মাটির পাহাড়ের কাছে

    মোবাইল: 01711071171, 01818664748

.

১০। হোটেল গুলশান

       মোবাইল: 01711150807

.

১১। বিচিত্রা গেস্ট হাউজ

       দুর্গাপুর বাসস্ট্যান্ডের সাথে

       মোবাইল: 01793695945




মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ