গোসল করে ফ্রেশ হয়ে সবাই লাঞ্চ করে বিছানায় চলে গেলাম। সন্ধ্যায় কেলেঙ্গা বাজারে ঘুরে, চা পান করলাম সাথে ডাক্তার স্বপনের দোকানে। ব্লগে লিখি শুনে উনি ব্লগ নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা করলেন। “ব্লগ আর ব্লগার মানেই নাস্তিক” এমন একটা ধারনা কেন জানি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। যাই হোক, আকাশে চাঁদ উঠতেই আমরা কটেজে ফিরে এলাম। তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল বারবিকিউ আয়োজনের। কয়লা গরম করে আগুন ধরানো, এরপর আগে থেকে মেরিনেট করে রাখা মুরগী আগুনে ঝলসানো শেষে যখন খেতে বসবো, হুট করে ভ্রমণ সাথী সাবিতের মাথায় ভুত চাপলো কলাপাতায় করে খাবার খাওয়া হবে। খাবার আয়োজন থামিয়ে লোকাল একজনকে ডেকে রাতের বেলা দা হাতে ঢুকে গেল বনের ভেতর। বনের শুরুতেই কিছু কলা গাছের ঝোপ দেখেছিলাম বিকেলে। বেশ কিছুক্ষণ পরে কিছু কলাপাতা নিয়ে হাজির হল। ওগুলোকে সাইজ করে, ধুয়ে নিয়ে আসার পর দেখা গেল পাতাগুলো কেমন দাগে ভরা এবং পোকায় খাওয়া। শেষে আর কি? খাও সেই প্লেটে করেই, মাঝখান থেকে আধঘণ্টা সময় নষ্ট।
খাওয়া শেষে ঘুমানোর পালা। তার আগে আমাদের কটেজ মালিক স্বপন ভাই আমাদের ফেরার পথের হদিস জেনে বললেন, এতোটা না ঘুরে বনের পাশ দিয়ে চা বাগানের ভেতর দিয়ে একটা শর্টকাট রাস্তা আছে। আমরা সেই রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে মূল সড়কে উঠে যেতে পারবো। ও হ্যাঁ, ২য় দিন আমাদের পূর্ব-পরিকল্পনা ছিল ‘সাতছড়ি’ যাওয়ার। কিন্তু ১ম দিন চার ঘণ্টা বনের ভেতর বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল ট্রেইল ধরে পায়ে হেঁটে হেঁটে সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম। তার উপর এরকম ট্যুর সবার জন্য এই প্রথম, তাও ঈদ ট্যুর! দলনেতা হিসেবে তাই প্রায় একই ধরনের ভ্রমণ পরিবর্তন করে সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম ২য় দিন আমরা যাব ‘মাধবকুণ্ড ইকো পার্ক’, দেখবো মাধবকুণ্ড এবং পরিকুণ্ড ঝর্না। তো আমাদের প্ল্যান শুনে কটেজের মালিক, লোকাল পল্লী চিকিৎসক, পরামর্শ দিলেন হবিগঞ্জ হয়ে মাধবকুণ্ড যেতে অনেক বেশী সময় লাগবে বিধায় আমরা বিকল্প পথ ব্যাবহার করে শ্রীমঙ্গল হয়ে মাধবকুণ্ড চলে যেতে পারি। এর জন্য আমাদের ঘণ্টা’খানেকের পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে, বন আর চা বাগানের ভেতর দিয়ে। আমরা সানন্দে রাজী হলাম। আগের রাতের সারা রাত নির্ঘুম কাটানোর পর কেলেঙ্গা বনে ট্রেকিং করে সবাই ছিলো ক্লান্ত। তাই খুব দ্রুতই সকলে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।
ভোরবেলা দ্রুতই ঘুম থেকে উঠে গেলাম আমরা। সকাল ০৬ঃ৩০ এর মধ্যে রওনা দিয়ে দিলাম স্বপন ভাইয়ের কটেজ থেকে। প্রথমে খুব উপভোগ করছিলাম এই হেঁটে চলা। কিন্তু যাত্রা শেষে খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যে পথ স্বপন ভাই বলেছিলেন ঘন্টাখানেকের তা অতিক্রম করতে আমাদের পাক্কা সাড়ে তিন ঘন্টা সময় হাঁটতে হলো। সকালের এই হাঁটা পথের এক ঘণ্টা মত ছিল ‘হুগলীছড়া চা বাগান’ এর ভেতর দিয়ে। দুইপাশে সারি সারি চা-গাছের টিলা, মাঝে মাঝে রাবার বাগান, নীল আকাশের নীচে চোখ জুড়ানো সবুজ... হাঁটার কষ্ট অনেকটাই লাঘব করে দিয়েছিলো চারিদিকের প্রকৃতি। এক সময় ক্লান্ত হয়ে এক টিলার উপর বসে পড়লাম সবাই, চলল ফটো সেশন। আমি আমার জুতো খুলে পা’টাকে একটু আরাম করতে দিলাম। এই ফাঁকে একটা জোঁক জুতোর ভেতর ঢুকে পড়লো। এরপর আমিতো জুতো পায়ে দিয়ে রওনা হলাম। প্রায় আধঘন্টারও পরে এক জায়গায় পানি পেয়ে সবাই যখন হাত-মুখ ধুতে ব্যস্ত, তখন আমি পা ধোঁয়ার জন্য জুতো খুলতেই দেখি এক পায়ের পাতা রক্তে পুরোটা লাল হয়ে আছে! জোঁক কখন রক্ত খেয়ে সরে পড়েছে আমি টের পাইনি। রক্ত বন্ধে পাতা থেতলে রস দিলাম, পরে এণ্টিসেপটিক ক্রিম দিয়ে ব্যান্ডএইড লাগিয়ে দিলাম। কিসে কি? পুরো ঘণ্টা দুয়েক রক্ত ঝরল আমার জোঁকে কাটা পায়ের পাতার উপরিভাগ হতে। যাই হোক অবশেষে একসময় আমরা কাঙ্ক্ষিত শ্রীমঙ্গল মূল সড়কে উঠে এলাম।
শ্রীমঙ্গল পৌঁছেই ঢাকা ফেরার টিকেট কেটে নিলাম, আমরা বাস ধরবো বড়লেখা হতে, বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। এরপর শ্রীমঙ্গল হতে আমরা সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে রওনা হলাম মাধবকুণ্ড, যাত্রা পথে অতিক্রম করবো হাকালুকি হাওর। হাকালুকি হাওর পৌঁছলে ড্রাইভারকে গাড়ী থামাতে বললাম, সবাই নেমে কিছু ছবি তুলে নিলাম। ফের গাড়ীতে উঠে গাড়ী স্টার্ট নিতেই আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। আমার থাইয়ের প্যান্টের উপর হলদে-সবুজ রঙের ইঞ্চি ছয়েক লম্বা একটা সাপ না গিরগিটি কিছু একটা পড়ল, তাকিয়ে দেখি তার আবার চারটা পা! আমি চিৎকার করতেই গাড়ী ব্রেক করলো এবং লাফ দিয়ে গাড়ী হতে নেমে আমি লম্ফ-ঝম্ফ আরম্ভ করে দিলাম। আমার লাফালাফির ঝাকুনি সহ্য করতে না পেরে প্রাণীটি লাফ দিয়ে রাস্তার পাশের ঝোপে পালালো। পরে ড্রাইভার বলল, ঐটার নাম ‘মুই হাপ’! মনে মনে বললাম এইটা কি গুই সাপের মামাতো ভাই ;) । পেছন থেকে কে যেন একজন বলল ধুর ছবি তুলতে পারলাম না ঐ সাপটার!!!
মাধবকুণ্ড ঝর্না যখন দেখতে গেলাম, আমি বাঁধানো রাস্তার এক পাশে লাগেজগুলো নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম, বাকিদের বললাম ঝটপট ছবি তুলে চলে আসতে। মাধবকুণ্ড, পরিকুণ্ড ঝর্ণায় তেমন পানি না থাকলেও সাধারণ পর্যটকদের কাছে এখনো খুব জনপ্রিয় এই ঝর্ণাদ্বয়। এখানে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা রওনা দিলাম বড়লেখা বাস কাউণ্টারে। টিকেট করার সময় দেখেছিলাম টিকেটের গায়ে বাস ছাড়ার সময় লেখা ছিল ৬:৪০ শ্রীমঙ্গল থেকে, কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম বড়লেখা থেকে বাসে উঠতে হবে সাড়ে পাঁচটায়। আমরা পাঁচটা নাগাদ যখন বড়লেখা’র দিকে যাচ্ছি তখন আমাদের পরিবহণের একটা বাস আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। সন্দেহ হল, এটাই কি আমাদের বাস? ড্রাইভারকে বললাম পিছু নিতে, সে বলল সম্ভব না। কাউণ্টারে ফোন করে জানলাম ঘটনা সত্য, যা ভেবেছি তাই ঘটেছে। আমরা বাস মিস করেছি... কাউন্টারে গিয়ে কিছক্ষণ তর্ক করে ক্ষ্যান্ত দিলাম। পরবর্তী বাস রাত এগারোটায়, সেটায়ও সিট পেলাম একেবারে পেছনের দিকে। এই ট্যুরে ঢাকা থেকে যাওয়া-আসা দুই পথেই ভালো বাস বা ভালো সিট কপালে লেখা ছিলো না। তবে এইটা ছাড়া বাকী সবকিছুই ছিলো চমৎকার।
মন্তব্যসমূহ