বর্তমান সময়ে ‘কাশিমপুর’ নামটি রাজনৈতিক কারণে খুব পরিচিত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বন্দীদের ‘কাশিমপুর কারাগার’ এ নিয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু কাশিমপুরেই রয়েছে এক পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ী। আর দশটি জমিদার বাড়ীর মতই নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে এই জমিদার বাড়ীটি। কাশিমপুরের জমিদার রায়বাহদুর কেদারনাথ লাহিড়ী’র এই জমিদার বাড়ীটি কালের স্রোতে হারিয়ে যেতে দিন গুনছে। ইতোমধ্যে এর অর্ধেক ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ এর ‘সমাজসেবা অধিদফতর’ এর ‘সরকারী আশ্রয় কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যাবহৃত হচ্ছে। জমিদার বাড়ীগুলোর এই বহুবিধ ব্যবহার দেখে বাসাবাড়ির ‘ষ্টোর রুম’ এর কথা মনে পড়ে গেল। অপ্রয়োজনীয় ঘরে যেমন দুনিয়ার জঞ্জাল জমা করে ষ্টোর রুম নামে ব্যাবহার করি আমরা, তেমনি জমিদার বাড়ীগুলো একালের জঞ্জাল, আর তাই এগুলোর বহুবিধ ব্যবহার।
গত এপ্রিলে গিয়েছিলাম গাজীপুরের কালিয়াকৈর, জমিদার বাড়ীর খোঁজে। ফিরতি পথে বিকেল বেলা ঢুঁ মারতে চলে যাই কাশিমপুর জমিদার বাড়ীতে। গাজীপুরপুর-কালিয়াকৈর সড়কে কালীবাড়ি বা কাশিমপুর বাসস্ট্যান্ড নেমে কাশিমপুর কারাগার রোড ধরে এগিয়ে গেলাম। পথ যেন শেষ হয় না, মনে সন্দেহ সঠিক পথে যাচ্ছি কিনা তাই নিয়ে। হাতে তেমন পর্যাপ্ত তথ্যও নেই, স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেও তেমন সুবিধা হল না। রিকশাওয়ালাকে ভরসা করে কাশিমপুর কারাগার ডানে রেখে আরও ভেতরে এগিয়ে গেলাম। অনেকটা পথ যাওয়ার পর পেলাম গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এর আঞ্চলিক কার্যালয় – ০৫ (কোনাবাড়ী-কাশিমপুর)। এখান হতে ২০০ গজ সামনে গেলে পাবেন এই কাশিমপুর জমিদার বাড়ী।
আমি ইটের ফুট আটেক উঁচু পাঁচিল দেখে প্রথমে বুঝতেই পারিনাই এটা কোন জমিদার বাড়ী। আমি একটু পেছনের দিকে চলে গিয়েছিলাম, যে পাশটায় সমাজসেবা অধিদফতরের আশ্রয়কেন্দ্রটি রয়েছে সেখানে। পড়ে আবার মূল সড়কের দিকের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকার ফটক খুঁজে পেলাম। ফটক ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম একটা মোটামুটি বড় সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ, যেটার শেষ প্রান্তে মূল বাড়ীর কাঠামো শুরু। সেখানে এক মাঝ বয়সী মহিলাকে দেখলাম কেশ চর্চায় ব্যাস্ত। তাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলাম অন্দরমহলে যাওয়া যাবে কিনা। ইতিবাচক উত্তর পেতে পা বাড়ালাম ভেতর পাণে।
পরিত্যাক্ত বেশীরভাগ জমিদার বাড়ী হয় দখল করে আবাসে পরিণত করেছে স্থানীয় লোকে, অথবা ভগ্নস্তুপ হয়ে পড়ে থাকে। কিছু পাওয়া যায়, জমিদারের উত্তরাধিকারদের আত্মীয়-স্বজন বা দূর সম্পর্কের কেউ বসবাস করে। কাশিমপুর জমিদার বাড়ীতে শেষের অবস্থা বিদ্যমান, অর্থাৎ জমিদারের উত্তরাধিকারদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন বসবাস করছেন। ইতিহাস তেমন কিছু তাদের কাছ থেকে জানা গেল না।
কাশিমপুরের জমিদার রায়বাহদুর কেদারনাথ লাহিড়ী এই জমিদার বাড়ীর গোড়াপত্তন করেন। আনামি প্রাসাদ রায় চৌধুরী ছিলেন কাশিমপুরের শেষ জমিদার। তাদের এই জমিদারী ছিল কাশিমপুর এবং বলধা জুড়ে। এই জমিদার বাড়ীর ইতিহাস নিয়ে খোঁজ করে তেমন কিছু আমি যোগাড় করতে পারি নাই, তবে খোঁজে আছি। কারো কাছে তেমন কোন তথ্য থাকলে শেয়ার করতে অনুরোধ রইল।
জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ।