একটি ভ্রমণের অনেকগুলো টুকরো গল্প

#
আজকের লেখার ছোট গল্পগুলো এই ঈদের ছুটিতে ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ এর একটি ছোট গ্রুপ নিয়ে আমার হবিগঞ্জ আর মৌলভীবাজার ভ্রমণ হতে নেয়া। ঈদের পরদিন রাত ১২টার গাড়ীতে ৬ জনের ছোট্ট একটা দল রওনা হই হবিগঞ্জের সায়েস্তাগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে। ভোররাতে পৌঁছই সায়েস্তাগঞ্জ, আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করে ভোর পাঁচটায় একটা সিএনজি অটো রিকশা করে রওনা হই ‘কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’র উদ্দেশ্যে। আসুন শুরু করা যাক টুকরো গল্প'র ঝুড়ি।

(১) ধুম ড্রাইভঃ গ্রামের রোগা-পাতলা লোকটি ড্রাইভার’কে এক ধমক দিয়ে বলল, ‘ব্যাটা তুই সর, এই গাদ্দা ফার করবার পারছনা...’। বলে ড্রাইভারকে সরিয়ে সে ড্রাইভিং সিটে বসল। এবার অবাক হবার পালা, লোকটি ড্রাইভারকে বলে, ‘ঐ ব্যাটা গাড়ী স্টার্ট দিয়া দে...’। ড্রাইভার গাড়ী স্টার্ট দিয়ে লোকটিকে গাড়ী’র ড্রাইভিং সিট ছেড়ে দিতেই সে ধুম সিরিজের মুভির মত করে ভয়াবহ সেই কাদা থকথকে বিশাল গর্ত দিয়ে অনায়াসে চোখের নিমিষে গাড়ী পার করে নিয়ে আসলো। আমরা পুরাই থ মেরে গেলাম। যে লোক গাড়ী স্টার্ট দিতে জানেনা, সে লোক কেমন করে এত নিখুঁতভাবে গাড়ী চালাতে পারল? গাড়ী একচুল এদিক সেদিক হয় নাই! 

 (২) দ্যা সিক্সথ ম্যানঃ এবার ঈদে ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ এর মূল ইভেন্ট ছিল ‘স্বপ্নের সাজেক ভ্যালী’; আর তাই আমাদের এই ইভেন্টে লোক পাচ্ছিলাম না। পাঁচজন কনফার্ম হওয়ার পর মনে মনে আরেকজন আশা করছিলাম। ছয়জন হলে জোড় মিলে যায়। তাই এই লাকি সিক্সথ এর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে একজন পেয়েও গেলাম, একেবারে শেষের দিন এসে। কিন্তু বিধিবাম, এই সিক্সথ ম্যানের কারণে পুরো ট্যুর এ ট্রান্সপোর্ট নিয়ে ভালো বিপাকে ছিলাম। হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের দিকে অন্যতম আভ্যন্তরীণ যান হল সিএনজি অটোরিকশা; যার প্যাসেঞ্জার ক্যাপাসিটি হাইয়েস্ট ফাইভ। তাই সিক্সথম্যান’কে জায়গা করে দিতে পেছনের তিন ভ্রমণসাথীকে ব্যাপক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। যদিও সবাই তা হাসিমুখে মেনে নিয়েছে।

(৩) আজিব ব্যাপারঃ সিএনজি অটোরিকশা বিদায় করে আমরা পায়ে হেঁটে কেলেঙ্গা বাজারস্থ আমাদের আগে থেকে বুকিং করে রাখা কটেজের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কিছু দূর যেতে এক লোকাল বয়স্ক লোকের সাথে দেখা মিলল, তাকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এইতো মাত্র মাইল পাঁচেক দূরেই কেলেঙ্গা বাজার!!! গ্রামের স্থানীয় লোকের পাঁচ মাইল, তার মানে......? সবাইতো মহা ফাঁপরে, কেননা আজকে সারাদিন এমনিতেই কেলেঙ্গা ফরেস্টে প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা হাটতে হবে; তার উপর এই পাঁচ মাইল। ‘ছাইরা দে মা, কাইন্দা বাঁচি’ অবস্থা। তারপরও সকাল বেলা বলে মিষ্টি রোদে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যেতে ভালই লাগছিলো। কিন্তু আজিব ব্যাপার ঘটলো, যখন আধঘণ্টা’র একটু বেশী চলার পর আমরা পৌঁছে গেলাম কেলেঙ্গা বাজারে! সারাজীবন দেখে আসলাম, গ্রামের লোকের এক মাইল মানে এক ঘণ্টার পথ, এখন দেখি আধঘণ্টায় পাঁচ মাইল!!! 

(৪) বনের মাঝে বৃষ্টি বিলাসঃ প্রায় চার ঘণ্টা সময় বনের গহীনে হেঁটে হেঁটে যখন পা ব্যাথায় টনটন করছে, তখন ঝুম করে নামলো বৃষ্টি। সবাইকে বলা ছিল অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে রেইন কোট অথবা ছাতা নিতে। দু’একজন ছাড়া কেউ ঢাকা থেকে দুটোর কোনটাই সাথে করে নিয়ে যায় নাই, আর যারা নিয়েছিল তারা ব্যাগের ভেতর কটেজে রেখে এসেছে। এখন সবাই ঝুম বৃষ্টিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলো বড় বড় কলাপাতা বা এই রকমের পাতার সন্ধানে। খুব মজা পেলাম, কারণ দুজন এক কাপড়ে বেড়াতে এসেছে, তাও পড়নে জিন্স! আমি মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজেছি, আমার ঢাকা থেকেই প্ল্যান ছিল বনের ভেতর বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজবো, ভিজেছিও। 

(৫) কলাপাতা’য় বার-বি-কিউঃ সাবিত এই প্রথম ভ্রমণ বাংলাদেশের কোন ইভেন্টে জয়েন করলো। খুব এক্সাইটেড সব কিছু নিয়ে, ওর রিকোয়েস্টেই আমি এই কেলেঙ্গা বনের মাঝে বার-বি-কিউ এর আয়োজনের ঝামেলা করতে রাজী হই। রাতের বেলা, কটেজ একেবারে কেলেঙ্গা বনের প্রবেশের মুখে। আঁধার রাতে কটেজের বাইরে তাবু (টেণ্ট) টাঙ্গিয়ে কয়লায় গনগনে তাপে যখন বার-বি-কিউ প্রায় হয়ে এসেছে, খেতে বসবো সবাই খোলা আকাশের নীচে, সাবিতের মাথায় ভূত চাপলো কলাপাতায় করে খাওয়া হবে, প্লেটে নয়। এই গভীর রাতে লোকাল একজন কে সাথে নিয়ে দা হাতে বের হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে কিছু কলাপাতা নিয়ে হাজির হল। ওগুলোকে সাইজ করে, ধুয়ে নিয়ে আসার পর দেখা গেল পাতাগুলো কেমন দাগে ভরা এবং পোকায় খাওয়া। শেষে আর কি? খাও সেই প্লেটে করেই, মাঝখান থেকে আধঘণ্টা সময় নষ্ট। 

(৬) শর্টকাটঃ ২য় দিন আমাদের পূর্ব-পরিকল্পনা ছিল ‘সাতছড়ি’ যাওয়ার। কিন্তু ১ম দিন চার ঘণ্টা বনের ভেতর বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল ট্রেইল ধরে পায়ে হেঁটে হেঁটে সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম। তার উপর এরকম ট্যুর সবার জন্য এই প্রথম, তাও ঈদ ট্যুর! দলনেতা হিসেবে তাই প্রায় একই ধরনের ভ্রমণ পরিবর্তন করে সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম ২য় দিন আমরা যাব ‘মাধবকুণ্ড ইকো পার্ক’, দেখবো মাধবকুণ্ড এবং পরিকুএন্ড ঝর্না। তো আমাদের প্ল্যান শুনে কটেজের মালিক, লোকাল পল্লী চিকিৎসক, পরামর্শ দিলেন হবিগঞ্জ হয়ে মাধবকুণ্ড যেতে অনেক বেশী সময় লাগবে বিধায় আমরা বিকল্প পথ ব্যাবহার করে শ্রীমঙ্গল হয়ে মাধবকুণ্ড চলে যেতে পারি। এর জন্য আমাদের ঘণ্টা’খানেকের পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে, বন আর চা বাগানের ভেতর দিয়ে। আমরা সানন্দে রাজী হলাম। পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ৬:৩০ এর দিকে রওনা হলাম। পুরো তিন ঘণ্টা হেঁটে, শরীরের সব শক্তি খুইয়ে আমরা ঐ হাঁটা পথ শেষ করি। অতি লোভে, তাঁতই নষ্ট। 

(৭) রক্তাক্ত পাঃ সকালের এই হাঁটা পথের এক ঘণ্টা মত ছিল ‘হুগলীছড়া চা বাগান’ এর ভেতর দিয়ে। দুইপাশে সারি সারি চা-গাছের টিলা, মাঝে মাঝে রাবার বাগান, নীল আকাশের নীচে চোখ জুড়ানো সবুজ... এক সময় ক্লান্ত হয়ে এক টিলার উপর বসে পড়লাম সবাই, চলল ফটো সেশন। আমি আমার জুতো খুলে পা’টাকে একটু আরাম করতে দিলাম। এই ফাঁকে একটা জোঁক জুতোর ভেতর ঢুকে পড়লো। এরপর আমিতো জুতো পায়ে দিয়ে রওনা হলাম। পরে এক জায়গায় পানি পেয়ে সবাই যখন হাত-মুখ ধুতে ব্যস্ত, তখন আমি জুতো খুলতেই দেখি এক পায়ের পাতা রক্তে পুরোটা লাল হয়ে আছে! জোঁক কখন রক্ত খেয়ে সরে পড়েছে আমি টের পাইনি। রক্ত বন্ধে পাতা থেতলে রস দিলাম, পরে এণ্টিসেপটিক ক্রিম দিয়ে ব্যান্ডএইড লাগিয়ে দিলাম। কিসে কি? পুরো ঘণ্টা দুয়েক রক্ত ঝরল আমার জোঁকে কাটা পায়ের পাতার উপরিভাগ হতে। এখনো ঐ জায়গাটা কালো হয়ে আছে। 

(৮) গাড়ীর ভেতর গায়ে উঠলো সাপঃ শ্রীমঙ্গল থেকে মাধবকুণ্ড যাওয়ার পথে পড়লো হাকালুকি হাওড়। ড্রাইভারকে গাড়ী থামাতে বললাম, সবাই নেমে কিছু ছবি তুলে নিলাম। ফের গাড়ীতে উঠে গাড়ী স্টার্ট নিতেই আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। আমার থাইয়ের প্যান্টের উপর হলদে-সবুজ রঙের ইঞ্চি ছয়েক লম্বা একটা সাপ না গিরগিটি কিছু একটা পড়ল, তাকিয়ে দেখি তার আবার চারটা পা! আমি চিৎকার করতেই গাড়ী ব্রেক করলো এবং লাফ দিয়ে গাড়ী হতে নেমে আমি লম্ফ-ঝম্ফ আরম্ভ করে দিলাম। আমার লাফালাফির ঝাকুনি সহ্য করতে না পেরে প্রাণীটি লাফ দিয়ে রাস্তার পাশের ঝোপে পালালো। পরে ড্রাইভার বলল, ঐটার নাম ‘মুই হাপ’! মনে মনে বললাম এইটা কি গুই সাপের মামাতো ভাই ;) । পেছন থেকে কে যেন একজন বলল ধুর ছবি তুলতে পারলাম না ঐ সাপটার!!! 

(৯)গামছা রে গামছাঃ মাধবকুণ্ড ঝর্না যখন দেখতে গেলাম, আমি বাঁধানো রাস্তার এক পাশে লাগেজগুলো নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম, বাকিদের বললাম ঝটপট ছবি তুলে চলে আসতে। বেলা তখন প্রায় তিনটা, সাড়ে পাঁচটায় গাড়ী। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝর্নার পানি পড়া দূরে থেকে দেখছি। আমার সামনে একটা পরিবার ফটো সেশনে ব্যাস্ত। তাদের ফটো সেশন শেষে চলে যাওয়ার সময় দেখি বছর ত্রিশের এক যুবতী আমার পাশ দিয়ে আমাকে অতিক্রম করার সময় তার সাথের পিচ্চিকে বলছে, ‘গামছা রে গামছা’। আমি ফিরে দেখি ব্যাঙ্গাত্মক একটা হাসি, বুঝতে একটু সময় লাগলো আমার। আমার গলায় তখন গামছা (যে কোন ট্যুরে আমরা গামছা মাথায় বেঁধে বা গলায় রাখি, এর বহুবিধ ব্যাবহারের জন্য), তার মানে কথাটা আমাকে বলা! এযে ‘অ্যাডাম টিজিং’। মনে মনে গালি দিলাম, ঐ মাইয়া আমি কি তোরে দেখছিলাম নাকি এতক্ষন? হায় খোদা, আমিতো পুরাই বেকুব হয়ে গেলাম। যদিও মেয়েটি সুন্দরীই ছিল, আগে জানলে বিনা দোষে দোষী না হয়ে একটু দোষ করা উচিত ছিল।

(১০) মিসটাইমিংঃ সকাল বেলা শ্রীমঙ্গল পৌঁছেই ঢাকা ফেরার টিকেট কেটে নিয়েছিলাম সেখান থেকে, কিন্তু উঠবো বড়লেখা কাউণ্টার হতে। সময় লেখা ছিল ৬:৪০ শ্রীমঙ্গল থেকে, বড়লেখা থেকে কয়টায় জিজ্ঞাসা করতে বলল সাড়ে পাঁচটায়। আমরা পাঁচটা নাগাদ যখন বড়লেখা’র দিকে যাচ্ছি তখন আমাদের পরিবহণের একটা বাস আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। সন্দেহ হল, ড্রাইভারকে বললাম পিছু নিতে, সে বলল সম্ভব না। কাউণ্টারে ফোন করে জানলাম ঘটনা সত্য, যা ভেবেছি তাই ঘটেছে। আমরা বাস মিস করেছি... কি আর করা, রাত এগারোটা’র বাসে পেছনের দিকের সিটে ঢাকায় ফেরা।
 

ভ্রমণকালঃ ৩১ জুলাই-০১ আগস্ট, ২০১৪

পরের পর্ব

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ