শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ী ভ্রমণ শেষে রওনা হলাম বলিয়াদি জমিদার বাড়ীর উদ্দেশ্যে। দুপুর তখন প্রায় মাঝামাঝি, লাঞ্চ করার সিদ্ধান্ত স্থগিত করে আগে বলিয়াদি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। দুদিকে সোনালি ধানের ক্ষেত, কোথাও কোথাও ধানা কাটা শেষে ন্যাড়া মাথা হয়ে বোকাসোকা ফসলের মাঠটা চেয়ে আছে যেন আমার দিকে। পথে রেল লাইন পরলে আমি নেমে পড়লাম, সেখানে কয়েকটা ছবি তুলে আবার চলতে লাগলাম বলিয়াদি জমিদার বাড়ীর উদ্দেশ্যে। গত মে মাসের শুরুর দিকে ‘জমিদার বাড়ী’ সিরিজের লেখার জন্য ঢুঁ মারি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর এবং তদসংলগ্ন এলাকা। এবারের লেখা সেই ভ্রমণের ‘বলিয়াদি জমিদার বাড়ী’ নিয়ে।
পিচঢালা পথ হতেই চোখে পড়ল অন্যরকম সুন্দুর এই জমিদার বাড়ীটি। জমিদার বাড়ীর সীমানায় ঢোকার মুখে হাতের ডান পাশে একটি পুকুর পড়বে আর বাম পাশে এক টুকরো খোলা মাঠ। এই মাঠ ধরে একটু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে হাতের বাম পাশের রয়েছে একটি মসজিদ রয়েছে, নাম ‘বলিয়াদি ওয়াকফ এস্টেট জামে মসজিদ’। মসজিদটি প্রথম নির্মাণ করা হয় ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে, কিন্তু সেই মসজিদটি এখন আর নেই। মসজিদটি পুনঃনির্মিত হয়েছে ১৯৯২ সালে। চার কোনায় চারটি এবং প্রতি বাহু’র মাঝে একটি করে মোট আটটি ছোট্ট মিনার রয়েছে এই একতলা বর্গাকৃতির মসজিদটিতে।
হাতের বাম পাশে মসজিদ রেখে সামনে এগিয়ে গেলে রয়েছে মূল জমিদার বাড়ীর ভবন। মসজিদ এর ঠিক সম্মুখভাগে রয়েছে পারিবারিক কবরস্থান। এই কবরস্থান আর মূল ভবনের মাঝে রয়েছে ১৬১২ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বলিয়াদি এস্টেটের ‘হেড অফিস’ তথা ‘সদর দফতর’ যেথা হতে বলিয়াদি এস্টেটের সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হত।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান বলে ইংরেজি ১৬১২ খৃষ্টাব্দে সমগ্র কালিয়াকৈর থানা, ধামরাই থানা, সাভার থানা এবং বাসাইল থানা নিয়ে বলিয়াদি এস্টেট প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সময়ে কালিয়াকৈর থানার নাম ছিল পরগনা তালেবাবাদ। ধামরাই এবং সাভার থানার একসাথে ছিল, যার নাম ছিল পরগনা চন্দ্রপ্রতাপ। অপরদিকে বাসাইল থানার নাম ছিল পরগনা আমেনাবাদ। বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী এই এস্টেটের দিল্লী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর কর্তৃক নিযুক্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবেদার নবাব কুতুবুদ্দিন সিদ্দিকীর পুত্র নবাব সাদ উদ্দিন সিদ্দিকী বলিয়াদী এস্টেটের প্রথম কর্ণধার ছিলেন। বর্তমান ডাক সাইটে রাজনীতিবিদ, বিএনপি নেতা চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী’র পূর্বপুরুষ হলে এই বলিয়াদি জমিদারেরা।
জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ। কিন্তু এই বলিয়াদি জমিদার বাড়ী তার পরবর্তী প্রজন্মের যত্নে আজো ভালো অবস্থায়ই টিকে আছে অন্যান্য জমিদার বাড়ীর তুলনায়।
অপূর্ব নির্মাণশৈলীর এই জমিদার বাড়ীর মূল পাঁচিলঘেরা অংশে মাঝখানে ত্রিতল জমিদার বাড়ীর মূল কাঠামো। মূল বাড়ীর ছাদে রয়েছে সফেদ গুম্বজ, যার চারিদিকে প্রতিটি ভিতের মাথায় রয়েছে ছোট ছোট মিনার আকৃতির নকশা। সামনে সবুজ ঘাসের লনে বসে আপনি অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবেন একটি আনন্দঘন বিকেলবেলা। ঢাকা হতে যে কোন বাসে করে কালিয়াকৈর চলে আসুন অথবা যে কোন জেলা হতে। এখানে এসে যে কোন রিকশা বা অটো রিকশা’কে বলিয়াদি জমিদার বাড়ী বললেই আপনাকে নিয়ে পৌঁছে দিবে বলিয়াদি জমিদার বাড়ী প্রাঙ্গনে। বলিয়াদি অফিসের যে প্রশাসনিক কার্যালয় আছে সেখান হতে অনুমতি নিয়ে আপনি ভেতরে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখতে পারেন এর চারিপাশ। এর নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী আশা করি আপনার ভালো লাগবে।
আমার ছোট্ট ক্যামেরায় তোলা মূল ভবনের কিছু লংশট পিকচার আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম উপরের ফটো স্লাইডারে। জমিদার বাড়ীর ভেতরটা অগ্রিম অনুমতি (যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট হতে) নেয়া হয় নাই বলে ঘুরে দেখতে পারি নাই; ফলে ছবিও তুলতে পারি নাই।
ভ্রমণকালঃ ০৪ অক্টোবর, ২০১৩