ঈদুল ফিতরের সপ্তাহ খানেক পরে "ভ্রমণ বাংলাদেশ" আয়োজিত ইভেন্ট "হাওড় ও চায়ের দেশে" এর সাথে ফের ভ্রমণে বের হলাম। এবার আর ভুল করি নাই, অফিসে যাওয়ার আগে ব্যাগ পত্তর সব গুছিয়ে রেখে বের হয়েছিলাম, বাসায় ফিরে জাস্ট ব্যাগ নিয়ে চলে গেলাম রিকশা নিয়ে ফকিরাপুল বাস স্ট্যান্ড। শ্যামলী পরিবহনের নন-এসি বাসে করে ২৪ জনের দল রওনা হলাম ঢাকা হতে। পথে মাধবদীর কাছ হতে কামাল ভাইয়েরা চারজন আমাদের সঙ্গী হন। পরে দলের সাথে আরও চারজন যোগ দিলে মোট ৩২ জনের দল তিনদিনের ভ্রমণে একত্রিত হই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল ভ্রমণে। কারণ, আমাদের মূল গন্তব্য সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড় হলেও আমরা ঢাকা থেকে রওনা হই মৌলভীবাজার এর শ্রীমঙ্গল এর উদ্দেশ্যে। সারা রাত জার্নি করে একেবারে ভোররাতে আমরা পৌঁছে যাই শ্রীমঙ্গল।
এমন একটা সময়ে পৌঁছলাম যে, ঘুমাতে গেলেও সমস্যা, জেগে থাকাও সমস্যা। ভ্রমণ বাংলাদেশ থেকে শ্রীমঙ্গলে আগে থেকে রেস্ট হাউজ ঠিক করা ছিলো। সেখানে পৌঁছে দলের সবাইকে কয়েকটি রুম ভাগ করে দেয়া হলো। একে একে সবাই ফ্রেশ হয়ে যে যেখানে পাড়লো কাত হয়ে চোখ বুজে খানিক ঘুমিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। আমার এখন ঘুমানোর কোন ইচ্ছেই নেই। আমি আরও দু’চার জন ভ্রমণ সাথীর সাথে শুয়ে শুয়ে এইটা সেইটা গল্প জুড়ে দিলাম। কিন্তু এটাই ছিলো ভুল, কিছুক্ষণ পর শুরু হল বৃষ্টি, ফলে আমাদের শিডিউল টাইম পিছিয়ে গেল। ফলে যারা চোখ মুদেছিলো, তারা আরেকটু বেশী সময় ঘুমিয়ে নিতে পারলো। বৃষ্টি বেশ ভালোই হচ্ছিলো, রেস্ট হাউজের দোতলার বারান্দায় গিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখলাম। বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলে সবাইকে তাড়া দেয়া হল তৈরী হয়ে নেয়ার জন্য। আমরা বের হবো আমাদের প্রথম গন্তব্য মাধবপুর লেক এর উদ্দেশ্যে।
মৌলভীবাজার শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং শ্রীমঙ্গল থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে মাধবপুর লেকটি অবস্থিত। আমরা কমলগঞ্জ উপজেলা সদর দিয়ে প্রথমে গেলাম ন্যাশনাল টি কোম্পানির চা বাগানে। কেননা এই মাধবপুর লেকটি তাদের মাধবপুর চা বাগানের ১১ নম্বর সেকশন এ অবস্থিত। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা এই লেকটি একটি কৃত্রিম লেক। যেহেতু চা চাষের জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয় তাই সাধারণত বৃষ্টিবহুল এলাকাতেই চা বাগান দেখা যায়। কিন্তু পাহাড়ের ঢালে চা গাছগুলো থাকায় প্রচুর বৃষ্টি হলেও ঢাল বেয়ে সব পানি বয়ে চলে যায়। আর এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রায় প্রতিটি চা বাগানেই এই বয়ে যাওয়া পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার তৈরী করা হয়, যাকে ‘ডাম্প’ বলা হয়ে থাকে। তো ১৯৬৫ সালে মাধবপুর চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের চা বাগানের জন্য তিনটি ছোট পাহাড়ি টিলাকে বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলে এই মাধবপুর লেক।
আমরা ন্যাশনাল টি গার্ডেনে পৌঁছতে পৌঁছতে বৃষ্টি একেবারে থেমে গিয়েছিলো। দল বেঁধে সবাই চা বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। চললো নানান ঢঙ্গে ফটোগ্রাফি, নিজেদের সাথে প্রকৃতির। আমাদের সাথে চা বাগানের ভেতর কোথা থেকে যেন এক পাল ছাগল এসে জুটলো। তাদের দলও আমাদের দলের সাথে হাঁটতে লাগলো। এটা নিয়েও হলো নানান রসিকতা। তাদের সাথে ছবি তুললো কেউ কেউ সেই রসিকতার অংশ হিসেবে। হাসি তামাশায় সকালের গুমোট ভাব কেটে গেলো। এক সময় আমাদের দল এসে পৌঁছল মাধবপুর লেকের পাড়ে।
প্রায় ৫০ একর জায়গার উপর অবস্থিত এই মাধবপুর লেক প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ। কোথাও ৫০ মিটার চওড়া আবার কোথাও ৩০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। লেকের পাড় ঘেঁষে পায়ে হাঁটার সরু পথ চলে গিয়েছে, সেই পথ ধরে আমরা হাঁটতে লাগলাম। অনেকটা পথ হাঁটার পর একটা টিলার উপর খড়ের চালা এবং সেখানে একটা দোকান দেখতে পেলাম। পর্যটকদের জন্য সকাল আটটা হতে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত লেকে বেড়ানোর অনুমতি রয়েছে। এই লেকের দক্ষিণ দিকের যে টিলাটি রয়েছে তার পরেই ভারতীয় সীমান্ত এলাকা শুরু, এই টিলা থেকে ভারতীয় অংশের পাহাড়গুলো দেখা যায়। টিলার উপর অনেকটা সময় কাটিয়ে আমরা নেমে এলাম ফের লেকের পাড়ের হাঁটা পথে। লেকের জলে লাল শালুকের মেলা, স্থানীয় দুটি ছেলে শালুক তুলছিলো। আমাদের দলের মেয়েরা তাদের থেকে শাপলা ফুল নিয়ে কেউ কেউ খোপায় গোঁজার চেষ্টা করলো।
এই মাধবপুর লেকে নীল পদ্ম আর বেগুনী শাপলা ফোটে, সাথে গোলপাতা আর শালুকের ঝাড়। টিলার ঝোপে দেখা মেলে নানান বুনো ফুলের। নানান প্রজাতির গাছের ফাঁকে দেখা মেলে হরেক রকম পাখীর। বিশেষ করে লেকের জলে বিভিন্ন জাতের হাঁস, পানকৌড়ি এবং পরিযায়ী পাখীর দেখা মেলে। লেকের স্বচ্ছ জলে হুট করে ‘ঝপাস’ শব্দে কে যেন লাফিয়ে পড়লো! চমকে তাকাতে দেখি আমাদের দলের বন্ধু বেলাল নেমে পড়েছে জলকেলিতে। অনেকটা সময় এখানে কাটিয়ে আমরা রওনা হয়ে গেলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লাউয়াছড়ার উদ্দেশ্যে।
গল্পের ছবিসকল
মাধবপুর লেক
ন্যাশনাল টি কোম্পানির চা বাগান
ন্যাশনাল টি কোম্পানির চা বাগানের পথ ধরে আমরা ভ্রমণ বাংলাদেশের সবাই
মন্তব্যসমূহ