টাঙ্গুয়ার হাওড়ের রাত্রি শেষে

টাঙ্গুয়ার হাওড়ের রাত্রি শেষে
ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে আগে আমাদের জলযান ভিড়লো টেকেরঘাটে। টেকেরঘাটে আগে কয়লা খনি হতে পরিবহনের জন্য একটা রেল লাইন করা ছিলো, ঠিক তার কাছেই ভেড়ানো হলো আমাদের তরীটি। আমরা সেখানে পৌঁছে জায়গাটা ঘুরে দেখলাম, তুললাম বেশ কিছু ছবি। টেকেরঘাটে খনি কাজে খননের জন্য মাটি তোলা হলে সেখানটায় একটা জলাশয়ের তৈরী হয়েছে, যা দেখতে অনেকটা লেকের ন্যায়। 
আমরা এই সন্ধ্যে লগ্নের আলো আঁধারীতেই অনেক ছবি তুললাম। এরপর পুরো দল দুভাগে ভাগ করা হলো, একটি দল থাকবে জলযানেই আর অন্য দলটি থাকবে এখানকার একমাত্র গেস্ট হাউজে যা গড়ে উঠেছে এখানকার চেয়ারম্যান সাহেবের মালিকানায়। দল ভাগে মেয়ে-মহিলা সকলে এবং কিছু সিনিয়র সদস্য থাকবে রেস্ট হাউজে এবং বাকীরা বোটে; এমনটাই সিদ্ধান্ত হলো। তবে সকলেই প্রথমে চলে এলাম রেস্ট হাউজে, ফ্রেশ হওয়া এবং রাতের খাবার রেস্ট হাউজের সন্নিকটের একটি লোকাল খাবার হোটেলে। যেহেতু রাত হওয়ার অনেকটা সময় বাকী। তাই নিজেদের মত প্রয়োজন সেরে নিয়ে আমরা কয়েকজন চলে এলাম। 
একটা চায়ের দোকানে। দল বেঁধে চললো আড্ডাবাজি, সাথে চা পাণ। এরপর রাত নয়টার দিকে আমরা সবাই আমাদের রাতের খাবার সেরে নিলাম। এরপর আমরা রাতের আঁধার পথে টর্চ এর আলো জ্বেলে টেকেরঘাটে হাওড়ের প্রান্তে নোঙ্গর করা আমাদের জলযানে চলে এলাম। অনেকটা সময় ধরে ছাঁদে বসে চললো গল্পগুজব। এরপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামলে আমরা যারা উপরে ছিলাম তারা নীচে নেমে এসে ছাউনির ভেতর মাথা গুঁজে ঢুঁকে পড়লাম। কিন্তু ঢুঁকে দেখি সবাই এলোপাথাড়িভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আয়েশ করে ঘুমানোর জায়গা করে নিয়েছে এবং ইতোমধ্যে অনেকেই ঘুমিয়েও পড়েছে!!! 
যাই হোক, আমরা চার পাঁচজন ছিলাম বাকী, ভেতরের দিকে গিয়ে বন্ধু স্থানীয় কয়েকজনকে ঘুম থেকে তুলে, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কোন মত জায়গা করে নিলাম। এরপর শুরু হলো আমাদের ফের শুয়ে শুয়ে আড্ডাবাজি, তবে তা বেশীক্ষণ চললো না, কারণ আর কিছুই নয় যারা ঘমিয়েছিলো অথবা ঘুমানোর চেষ্টায় ছিল, তাদের বড্ড অসুবিধা হচ্ছিলো। ফলে অল্প ভলিউমে গান শুনতে লাগলাম আর বোটের জানালা দিয়ে হাওড়ের অথৈ জলের পাণে চেয়ে রইলাম, বহুদূরে কিছু বাড়িঘরের উঠোন হতে টিমিটিম জ্বলতে থাকা হলদে বাতির আলো বিন্দু হয়ে চোখে ধরা দিচ্ছিলো। আমি, মহি, সুমন আমরা কয়েকজন রাত প্রায় চারটা পর্যন্ত জেগে থেকে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। 
সুমনের গলার আওয়াজে ঘুম ভেংগে গেলো, কাঁচা ঘুম থেকে জেগে প্রথমেই কিছু বুঝতে পারলাম না। বোটের ছাঁদের অংশের ফাঁকে আমার মোবাইলখানি গুঁজে দিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম, সেখান হতে তা বের করে দেখি ভোর সোয়া পাঁচটার মত বাজে। মাত্র একঘন্টাও হয় নাই ঘুমিয়েছি, ভীষণ বিরক্ত লাগছিলো ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায়। কিন্তু একটু ধাতস্ত হতে বুঝতে পারলাম সুমনের মোবাইল পাওয়া যাচ্ছে না, কয়েকদিন আগেই প্রায় ত্রিশ হাজার দিয়ে শখের মোবাইলটি কিনেছে। পাটাতনের নীচে পড়ে যায় নাই তো, ফোন কল করে দেখা হল। ফোন কয়েকবার রিং করা হলো, ওপাশে রিং হচ্ছে, কিন্তু নিস্তব্ধ বোটের কোথাও কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আবারো রিং করা হলো, তৃতীয় দফা কেউ একজন ফোন রিসিভ করলো কিন্তু কোন কথা বলছে না। এরপর আরো বেশ কিছুক্ষণ রিং হল, কিন্তু একটা সময় মোবাইল আর রিং হলো না। এরপর দেখা গেল সারা বোট থেকে অনেকের অনেক কিছু খোয়া গেছে। কারো মোবাইল, কারো মানিব্যাগ, কারো পুরো ব্যাগপ্যাক, একজনের একটা শখের দামী মাছধরার হুইল ছিপ, আমার সদ্য কেনা দামী কেডসখানি রেখেছিলাম বোটের বাইরে, কি মনে হতে সেখানে গিয়ে দেখি সেটাও হাপিস হয়ে গেছে। মাত্র একঘন্টার জন্য পুরো বোটের সবাই ঘুমিয়েছিলাম, এর মধ্যেই কম্ম সারা। 
ভোরের আলো ফুটতেই মনা আর তাহসিন’কে ফোনে জানানো হলো ঘটনা, ওরা চলে আসলো রেস্ট হাউজ হতে। এরপর আরও কিছুটা সময় গেলে স্থানীয় থানায় রিপোর্ট করা হল, গতকাল আমরা এখানে আসার পর রাত দুটা নাগাদ পুলিশের মোটর বাইক এসে আমাদের দেখে গেছে। তারা আমাদের চুরির ঘটনাটির জিডি করে নিলো। থানার এসব ফরমালিটিস পূরণ করতে তাহসিন আর মনা থানায় গেল, আর সুমন, মহি আর আমার উপর দায়িত্ব দিলো পুরো দলকে নাস্তা করিয়ে বারিক্কার টিলা ঘুরিয়ে নিয়ে এসে সকাল নয়টার মধ্যে বোটে উপস্থিত থাকতে। সকাল নয়টার মধ্যে বোট না ছাড়লে যথাসময়ে সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছে ফিরতি বাস ধরা যাবে না।

গল্পের ছবিসকল

ভ্রমণকালঃ ১৬-১৭ আগস্ট, ২০১৩



আগের পর্ব পরের পর্ব

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ