অবশেষে চলে এলাম টাঙ্গুয়ার হাওড়

অবশেষে চলে এলাম টাঙ্গুয়ার হাওড়
আগের দিন সকালের মত আজ সকাল থেকে বৃষ্টি না থাকলেও আকাশ মেঘলা, যে কোন সময় বৃষ্টি হামলে পড়তে পারে। এরকম মেঘলা সকালেই সুনামগঞ্জের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন হোটেল হতে আমাদের ৩২ জনের দল রওনা হয়ে গেলাম টাঙ্গুয়ার হাওড় এর উদ্দেশ্যে। প্রথমেই এই বাসস্ট্যান্ড হতে একটা হিউম্যান হলার অর্থাৎ একটু ভদ্রগোছের টেম্পু’তে করে আমরা চলে এলাম ‘বৈঠাখালি’ নামক খেয়াঘাটে। সেখানে পৌঁছে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই ছেড়ে দিলো আমাদের খেয়া পারাপারের নৌকাটি। এরই মাঝে ঝিরিঝিরি করে নেমে আসা শুরু করলো মেঘ বালক-বালিকা’র দল। আমরা নদী পার হয়ে যথাসময়ে আমাদের রিজার্ভ করা হিউম্যান হলারগুলো এসে পৌঁছায় নাই। হালকা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা সেখানে একটা ছাউনি দেয়া চায়ের দোকানে অনেকে আশ্রয় নিলাম, কেউ কেউ চা পাণ এর সাথে জম্পেশ আড্ডা জুড়ে দিলো, আর দস্যিপনার কিছু বুড়ো খোকা তাদের দস্যিপনায় এই অলস সময়টুকু কাটিয়ে দিলো। বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষার পর হিউম্যান হলারগুলো উপস্থিত হলে আমরা তিন দলে ভাগ হয়ে তিনটি হিউম্যান হলারে চেপে রওনা হলাম তাহিরপুর এর উদ্দেশ্যে। সেখান থেকেই আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওড় এর জলযানে করে যাত্রা শুরু হবে মেঘালয়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা জনপদ ‘টেকেরহাট’ এর পাণে। 
বেশ খানিকটা পথ চলার পর এক সময় ডানদিকে চেয়ে দেখি দিগন্ত পাণে কালো আবছায়ার মত পাহাড়ের সারির অস্তিত্ব। আমার মতো অনেকেই চলন্ত টেম্পু হতে ছবি তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে একসময় টেম্পু চালককে বলা হলো ফাঁকা জায়গা দেখে তার গাড়ী সাইড করতে। একটা ফাঁকা ক্ষেতের ধারে সুবিধাজনক জায়গায় পার্ক করা হলো আমাদের টেম্পু। পেছনে থাকা অন্য দুই টেম্পু আমাদের ক্রস করার সময় আমরা ইশারা করে তাদের এগিয়ে যেতে বললাম। আমরা মিনিট দুয়েক ঝটপট ছবি তুলে নিলাম কিছু, যদিও মনের সাধ মিটলো না। তবে, যেহেতু আমরা সেই পাহাড়ের দিকেই যাচ্ছি, একটা সময় শুধু সেই পাহাড়গুলোই দৃষ্টিসীমানায় থাকবে, এতটুকু বোঝা গেল। আসলেও হয়েছিলো তাই, শেষ বিকেলে রোদ ঝলমলে আকাশে মেঘালয়ের পাহাড়ে মেঘেদের খেলা দেখতে দেখতেই আমরা পৌঁছেছিলাম টেকেরহাট। 
সেই গল্পে আসছি পরে। ঘন্টা দেড়েকের যাত্রা ছিলো সেই খেয়াঘাট পার হয়ে তাহিরপুর পর্যন্ত পৌঁছানো পর্যন্ত, সেই যাত্রাটা দারুন উপভোগ্য ছিলো। এই যাত্রার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ১০ ফিট চওড়া লম্বা ফিতার ন্যায় রাস্তা ধরে ছুটে চলা, যার হাতের ডানদিকে সারাক্ষণ রয়েছে মেঘালয় পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। হাওড় অঞ্চলে যখন পানি থাকে, তখন দুই দিকে পানি রেখে মাঝখান দিয়ে ছুটে চলার মাঝে অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করে। জলের মাঝে ছোট ছোট গ্রাম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কোথাও, কোথাও আবার গাছের শেকড়-কান্ড পানিতে নিমজ্জিত করে দাঁড়িয়ে থাকা, এসবের সাথে সারা দেহে খেলে যায় শীতল হাওয়ার ঝাঁপটা। সব মিলিয়ে অপূর্ব। 
ঘন্টা দেড়েক পরে আমরা তাহিরপুর পৌঁছালে সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম স্থানীয় হোটেলে, আগে থেকেই অর্ডার করে রেখেছিলো আয়োজক দল। দুপুরের খাবারে পর আমরা বাজার মত এলাকায় একটু ঘোরাঘুরি করে এলাম, এই ফাঁকে আমাদের নৌকায় বাজার সদাই তুলে নেয়া হলো। হাওড় ভ্রমণে এই জিনিষটাই একে স্বাতন্ত্র্যতা দিয়েছে অন্যান্য ট্যুরের থেকে। পুরো সময়টা এই জলযানেই আপনার আবাস, আপনার ভ্রমণ, আপনার সময় কাটানো সবকিছু। মাঝে মাঝে হয়তো কোথাও থামানো হবে, কখনো জলকেলি করার জন্য, কখনো বা আবার কোন চরের সবুজ জমিনে নেমে একটু ঘুরে দেখা সাথে হাঁটাহাঁটি করার জন্য। তারপর আবার সেই জলযানেই প্রস্থান। তবে আমার কাছে একটু কষ্টদায়ক হল এর নীচতলাটার উচ্চতা চার ফুটের মত। তাই সবসময় নীচু হয়ে সেখানে ঢুকতে হয়, বসে থাকতে হয় নইলে শুয়ে থাকতে হয়। দাঁড়ানো বা হাঁটা চলার জন্য উপরের তলা। আর একটা অসুবিধা এর টয়লেট সেই নীচতলা দিয়ে যেতে হয়, যেটা আরেক যন্ত্রণার। 
আমরা দুপুর তিনটার আগে আগে তাহিরপুর থেকে রওনা হয়ে গেলাম টেকেরহাটের উদ্দেশ্যে। সবাই দুপুরের রোদে শুয়ে বসে পুরোটা সময় গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। এরই মাঝে ৩২ জনের দলে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে আলাদা জগত করে নিয়েছে। কপোত কপোতী’র কেউ কেউ ছাতা বের করে মেলে দিয়েছে মাথার উপর রোদ থেকে বাঁচার অজুহাতে, হয়ত পেছনের উদ্দেশ্য এমন মায়াবী রোমান্টিক পরিবেশে এতো মানুষের ভীড়ে দুজনের কাছে আসার ইচ্ছেটুকু। আহ চারদিকে পানি, তার বুক চিরে চলেছে আমাদের জলযান। পানির এমন অপরুপ রূপ চোখকে দ্বিধান্বিত করে, মনকে উদাসী করে। চঞ্চল মন গেয়ে ওঠে,“আমার মন মজাইয়ারে, দিল মজাইয়া বন্ধে নিজের দেশে যায়...” 
সূর্য যখন ধীরে ধীরে পশ্চিমে ঢলে পড়ছে তখন ধীরে ধীরে মেঘালয়ের বিশাল পাহাড়ের সারি আমাদের কাছে তার রহস্যময় সৌন্দর্য্যের ডালি মেলে ধরছে। সবুজ পাহাড়ের বুকে মেঘেদের দলের ছুটে চলা, তার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা ভারতীয় বাড়িঘরও এক সময় দৃশ্যমান হয়ে ধরা দিলো চোখে। হাওড়ের সোনালী জলে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সোনালী আভার ছটা চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। আর এমন সব চিত্তাকর্ষক দৃশ্যপটে বুঁদ থেকে কখন বিকেলটা কেটে গেল বলতে পারবো না। এক সময় সন্ধ্যের আগে আগে আমরা পৌঁছে গেলাম টেকেরহাট, একেবারে মেঘালয়ের পাহাড়ের পাদদেশের বাংলাদেশের শেষ জনপদে।

গল্পের ছবিসকল

ভ্রমণকালঃ ১৬ আগস্ট, ২০১৩



আগের পর্ব পরের পর্ব

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ