লাউয়াছড়া বনে ভ্রমণ

যেহেতু আমাদের ভ্রমণ দলের বেশীরভাগ মানুষই চাকুরীজীবী এবং চাকুরীজীবীদের ছুটি ম্যানেজ করা বেশ কষ্টসাধ্যের ব্যাপার। তাই সাধ এবং সাধ্যের সম্মিলন ঘটাতে প্রতিটি ভ্রমণ পরিকল্পনায় অনেকেই চেষ্টা করেন বেশী সংখ্যক ভ্রমণ স্পট কাভার করার। আমাদের এই টাঙ্গুয়ার হাওড় ট্যুরেরও ছিলো সেরকমই একটা পরিকল্পনা। সরাসরি টাঙ্গুয়ার না গিয়ে ঢাকা থেকে মৌলভীবাজার এসে প্রথমে মাধবপুর লেক ভ্রমণ শেষে আমরা রওনা হলাম লাউয়াছড়ার উদ্দেশ্যে।
১৯২৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে এখানে বৃক্ষায়ন করে বনায়ন শুরু করা হয় এবং এক সময় তা বিস্তৃত ছিলো শ্রীমঙ্গল এবং কমলগঞ্জ উপজেলার মৌলভীবাজার ফরেস্ট রেঞ্জের আওতাধীন ২,৭৪০ হেক্টর এলাকা নিয়ে যা বর্তমানে ১২৫০ হেক্টর জমি নিয়ে টিকে আছে। বাংলার রেইন ফরেস্ট লাউয়াছড়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’কে ১৯৯৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। 
উঁচু-নিচু টিলায় বিস্তৃত এই বনের মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি এবং প্রচুর পাথর এর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় যা অন্যান্য রেইন ফরেস্ট এর তুলনায় ব্যতিক্রম। খ্যাতির দিক দিয়ে সুন্দরবনের চাইতে পিছিয়ে থাকলেও জীব বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে লাউয়াছড়া বলা চলে অনেকটাই এগিয়ে। আয়তনে ছোট হলেও দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর উপস্থিতি একে দিয়েছে আলাদা গুরুত্ব। লাউয়াছড়া বনে প্রবেশ করলে সারাক্ষণই নানান পাখী, কীটপতঙ্গ এবং প্রাণীর কলকাকলির পাশাপাশি টানা ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। 
লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যানে প্রায় দেড়শ’র উপরে রয়েছে উদ্ভিদ এর নানান প্রজাতি এবং প্রাণী’র মধ্যে রয়েছে ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। এই বনে রয়েছে বিলুপ্ত প্রায় উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, বানর, শিয়াল, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, এশীয় কালো ভাল্লুক, মায়া হরিণ প্রভৃতি। এর পাশাপাশি এই বনে নানান প্রজাতির সাপের মধ্যে অজগর রয়েছে যার বিচরণ বনের একটু গহীনে। রয়েছে ভিন্নতর হলদে পাহাড়ি কচ্ছপ।
লাউয়াছড়া বনাঞ্চলে রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গর্জন, সেগুন, গামার, মেনজিয়াম, জামরুল, চাপালিশ, নাগেশ্বর, শিমুল, লোহাকাঠ, জাম, ডুমুর, তুন, কড়ই প্রভৃতি। লাউয়াছড়া উদ্যান পাখী প্রেমীদের জন্য আকর্ষনীয় স্থান বটে। এখানে সারা বছরই বার্ড ফটোগ্রাফারদের আনাগোনা চলে; আর চলবেই না বা কেন? এই উদ্যানে দেখা মেলে সবুজ ঘুঘু, বনমোরগ, তুর্কি বাজ, সাদা ভ্রু সাতভায়লা, ঈগল, হরিয়াল, কালোমাথা টিয়া, কালো ফর্কটেইল. ধূসর সাত শৈলী, প্যাঁচা, ফিঙে, লেজকাটা টিয়া, কালোবাজ, হীরামন, কালো-মাথা বুলবুল, ধুমকল এর পাশাপাশি টিয়া, ছোট হরিয়াল, সবুজ সুইচোরা, তোতা, ছোট ফিঙ্গে, সবুজ কোকিল, পাঙ্গা, কেশরাজ প্রভৃতির।
লাউয়াছড়ার এই প্রাণবৈচিত্র উপভোগের জন্য বর্তমানে তিনটি ট্রেইল রয়েছে যা ধরে চক্রাকারে ঘুরে দেখতে পারে পর্যটকেরা। তিনটি পথের মধ্যে একটি ৩ ঘণ্টার পথ, একটি ১ ঘণ্টার পথ আর অপরটি ৩০ মিনিটের পথ। প্রশিক্ষিত গাইডের সহায়তায় বনের একেবারে ভেতর পর্যন্ত যাওয়া যায়। এই উদ্যানের পাশেই মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি রয়েছে যেখানে আদিবাসী খাসিয়ারা ছোট ছোট টিলার উপর বসত গড়েছে যাদের মূল পেশা পান চাষ। চাইলে লাউয়াছড়া বনে ভ্রমণের পাশাপাশি সেখান থেকেও বেড়িয়ে আসা যায়। 
প্রায় সারা বছরই লাউয়াছড়া দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে, তবে শীতকালে এই সংখ্যা বেশী হয়ে থাকে। আমরা টিকেট কেটে প্রেবেশ করলাম লাউয়াছড়ায়, আমাদের হাতে যেহেতু সময় কম ছিলো, তাই আমরা ছোট ট্রেইল ধরে ঘুরে দেখলাম দলবেঁধে। এরপর চলে এলাম লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া বিখ্যাত রেললাইন এর কাছে। শুরু হলো সকলের ফটোসেশন, নানান জন নানান ঢঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল এখানে। 
ভালো কথা ১৯৫৬ সালের অস্কার বিজয়ী হলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমা Around the World in 80 Days সিনেমার এক পর্যায়ে ট্রেনে করে ভারত ভ্রমণের সময় প্রায় পুরো অংশটুকুই শুটিং করা হয় মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। তাই আমরাও না হয় কিছুটা শ্যুটিং করে নিতেই পারি এখানে।লাউয়াছড়া ভ্রমণ শেষে আমরা বাসে করে রওনা দিলাম সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যে নাগাদ সেখানে পৌঁছে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন একটি হোটেলে উঠলাম আমরা। একটু পুরাতন ধাঁচের কিছুটা স্যাঁতস্যাঁতে হোটেলে একরাতের আবাসন, আগামীকাল সকালে আমরা এখান হতেই রওনা হবো তাহিরপুর হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওড়ের উদ্দেশ্যে, আমাদের আসল গন্তব্যস্থলের দিকে।

গল্পের ছবিসকল


ভ্রমণকালঃ ১৫ আগস্ট, ২০১৩



আগের পর্ব পরের পর্ব

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ