বারিক্কা টিলা ভ্রমণ ২০১৩

বারিক্কা টিলা ভ্রমণ ২০১৩

গল্পের ছবিসকল

  • মেঘালয়ের পাহাড়ের কোলে অপরূপা জাদুকাটা নদী
  • জাদুকাটা নদীতে স্থানীয় নৌকা ভেড়ানো
  • জাদুকাটা নদীর তীর
  • বারিক্কাটিলায়ও থেমে নেই বাঁদরামী
  • তাহসিন শাহেদ এর তোলা জাদুকাটার নীল জলে বেয়ে যাওয়া নৌকা
আগের রাতে শেষ প্রহরে আমাদের বোটে ঘটা চুরির ঘটনা পুরো ভ্রমণ দলের সবার মাঝেই কিছু বিরূপ প্রভাব ফেলে গেল। অনেকেই দোষারোপ করতে লাগলো একে ওকে, কিন্তু সবাইকে এই ব্যাপারে গতকাল বোট নোঙ্গর করার পরপরই দলের পক্ষ থেকে সাবধান করে বলা হয়েছিলো নিজ নিজ জিনিসপত্র নিজ দায়িত্বে সাবধানে রাখতে। আসলে বোটের ভেতরে এই ভোররাতে কেউ চুরি করতে আসতে পারে তা আমাদের ধারনারও বাইরে ছিলো। যাই হোক, আমি, সুমন আর মহি মিলে সবাইকে নিয়ে আগের রাতে যেখানে ডিনার করেছিলাম সেই খাবার হোটেলে নাস্তা সেরে নিয়ে আগে থেকে ভাড়া করে রাখা মোটর বাইক যোগে রওনা দিলাম বারিক্কার টিলার পাণে। আমি মোটাসোটা মানুষ তাই, একটা বাইকে চালকের সাথে আমি আর কাউকে শেয়ারে নিলাম না। 😜 
বারিক্কা টিলা মেঘালয়ের পাদদেশে বাংলাদেশ অংশে অবস্থিত উঁচু টিল যেখানে সীমান্ত খুঁটি দিয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে দুই দেশের সীমানা এলাকা। এই টিলার পেছনে মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়ের কোলে মেঘেদের দলের ছুটে চলা আর সম্মুখে বিস্তৃত স্বচ্ছ জলের ‘জাদুকাটা’ নদী, যার বুকে দাঁড়িয়ে চলছে জেলেদের মাছ ধরা, ছোট ছোট নৌকার সারি। মেঘ-পাহাড়-হাওর-নদী’র এই অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যে কেউ ভুলে যাবে সকল ক্লান্তি, গ্লানি। আর তাই আমাদের দলের সবাই যখন একে একে এখানে এসে পৌঁছলাম, কিছুক্ষণ আগেই ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কারনে ভার হয়ে থাকা মন নিমিষেই চাঙ্গা হয়ে গেল।
বারিক্কাটিলা আসার জন্য টেকেরঘাট হয়ে এলেও এর প্রকৃত অবস্থান লাউড়েরগড় নামক গ্রামে যার অবস্থান সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বড়দল উত্তর ইউনিয়নে। এর টিলার পেছনেই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়। এই বারিক্কা টিলার আশেপাশে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ’টির মত আদিবাসী পরিবারের বসবাস। প্রায় ৩৬৫ একর জায়গা জুড়ে ছড়ানো নানান গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে পুরো এলাকা। একেবারে জাদুকাটা নদীর তীরবর্তী খেয়াঘাটের কাছে কিছু দোকান রয়েছে সেগুলোর পাশ দিয়েই একটা সড়ক পথ উঠে গেছে টিলার উপরে। যতটুকু পারা যায় ততটুকু মোটর বাইকে পাড়ি দিয়ে আমরা বাকী পথ পায়ে হেঁটে উপরে চলে এলাম। 
বারিক্কা টিলার পাশেই ভারতীয় অংশের পাহাড়ে রয়েছে একটি তীর্থস্থান এবং একটি মাজার। প্রতি বছর নির্দিষ্ট তিথিতে ভিন্ন ভিন্ন উৎসবে জড়ো হয় স্ব স্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হাজারো অনুসারীরা। সেই সময় সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়া হয় স্থানীয় লোকজনের যাতায়াতের জন্য। বারিক্কা টিলার উপর থেকে দেখা যায় ভারতীয় অংশ দিয়ে চলে যাওয়া আঁকাবাঁকা সড়কপথে চলাচল করছে ভারতীয় বিভিন্ন যানবাহন; এই দৃশ্য গতরাতেও আমরা আমাদের বোট হতে দেখেছি, হেড লাইটের আলো জ্বেলে চলে যাওয়া ভারতীয় ট্রাকগুলোকে। 
বারিক্কা টিলা হতে জাদুকাটা নদীতে চলাচলকারী নৌকাগুলোকে দেখে মনে হয়ে শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোন ক্যানভাস যেন। আমাদের দলের বেশ কয়েকজন চাইলো নদী হতে ঘুরে আসতে, কিন্তু সময় একেবারে হাতে নেই; তাই তাদের বিরত করা হলো সেই প্ল্যান থেকে। আগামীতে সময় নিয়ে বারিক্কার টিলা ভ্রমণে আসা যাবে, এমনটা প্ল্যান করা হল। সবাইকে নিয়ে আমরা বোটে ফিরে এসে দেখি মনা আর তাহসিন থানা পর্ব চুকিয়ে আমাদের বোটে এসে ফেরার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। কিন্তু আমার চোখে তখনো খেলা করছে বারিক্কার টিলা হতে দেখা অপরূপ দৃশ্যপট। টিলার অনেক নীচে স্বচ্ছ পানির যাদুকাটা নদীর হাঁটু পানিতে স্থানীয় জেলেরা মাছ ধরছে, নদীর দুই পাড়ে নুড়িবালি ছড়ীয়ে রয়েছে। সূর্যের আলোতে তা চিকচিক করছে। আর টিলার পেছনে নদীর ওপারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়াবিনী মেঘালয়, যার আঁচলে সদা খেলা করে রূপের রাগিণীরা। চোখে দেখে বাস্তব বলে বিশ্বাস হয় না, মনে হয় বিশাল কোন এলইডি টেলিভিশনে কোন দৃশ্য। মনে তখন একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, খুব শীঘ্রই হাতে সময় নিয়ে চলে আসতে হবে বারিক্কার টিলা ভ্রমণে। 
সাড়ে নয়টা নাগাদ নৌকা ছেড়ে দিলো, এরপর লম্বা নৌকাপথে জার্নি। কারণ, আমরা এবার অনেকটা এগিয়ে গিয়ে সুনামগঞ্জের কাছাকাছি ঘাটে গিয়ে নামবো। আর সেখান থেকে বাসে করে চলে যাবো ঢাকা উদ্দেশ্যে। ফেরার পুরোটা পথ ছবি তুলে এবং প্রাণ ভরে উপভোগ করলাম টাঙ্গুয়ার হাওড়ের সৌন্দর্যর সবটুকু।  

ভ্রমণকালঃ ১৭ আগস্ট, ২০১৩



আগের পর্ব

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ