হাজীগঞ্জ দূর্গ ভ্রমণ এবং বোস কেবিনে চা পাণ

হাজীগঞ্জ দূর্গ ভ্রমণ এবং বোস কেবিনে চা পাণ
সেদিনের মূল গন্তব্যস্থল ছিল নারায়ণগঞ্জ চাষারা, কলিগের বিবাহোত্তর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে। তাই "রথ দেখা আর কলা বেচা" থিওরিতে খুব সকালে রওনা দিয়ে প্রথমে বেড়িয়েছিলাম পানাম নগরী এবং তার পর ঘুরে দেখেছি সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর। এইদুটো দেখে যখন মোগড়াপাড়া বাস স্ট্যান্ডে এলাম, ঘড়িতে তখন দুপুর বারোটা। হাতে এখনো দুই ঘন্টা সময় আছে। রওনা হলাম হাজীগঞ্জ দূর্গের উদ্দেশ্যে। লোকাল লোকদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম দুইটা পথ রয়েছে হাজীগঞ্জ যাওয়ার। প্রথমটি হল বাস ধরে চিটাগাং রোড হয়ে নারায়ণগঞ্জ দিয়ে হাজীগঞ্জ, আর অন্যটি হল মোগড়াপাড়া বাস স্ট্যান্ড হতে যে রাস্তাটি পানামের দিকে গেছে তার উল্টো দিকের রাস্তার সম্মুখ হতে সিএনজি করে নবীগঞ্জ ঘাটে পৌঁছে নদী পার হলেই হাজীগঞ্জ। সময় ২য় পথে কম লাগবে বলে সেটি বেছে নিলাম। শেয়ারে সিএনজি করে রওনা দিলাম নবীগঞ্জের দিকে। এই পথের রাস্তাটা ভাঙ্গা এবং সরু বলে কিছুটা সমস্যা হল যদিও তা আমার মতে ধর্তব্য নয়। 
আধঘণ্টার যাত্রা শেষে পৌঁছলাম নবীগঞ্জ। দুই টাকা দিয়ে টোকেন কেটে উঠলাম ইঞ্জিনচালিত নৌকায়, ঘাটে সাধারন নৌকাও ছিল। যাই হোক ভালো লাগলো বোট অপরপ্রান্তে পৌছার পর যখন শুনলাম ঐ দুই টাকার টোকেনই নৌকার ভাড়া, আলাদা কোন ভাড়া দেয়া লাগে না। ভাল উদ্যোগ, মনে দাগ কাটল। অপরপ্রান্তে হাজীগঞ্জ ঘাট হতে বের হয়ে বাম দিকে মিনিট দুয়েক হাঁটলে হাতের ডানদিকে চোখে পড়বে একটা সরু গলি, এই গলির ভেতরেই রয়েছে হাজীগঞ্জ দুর্গ। গলির মুখে একটি সাইনবোর্ড রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। 
বাংলার মোগল স্থাপত্যের এক অনুপম নির্দশন নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ দুর্গ। শহরের হাজীগঞ্জ এলাকায় এর অবস্থান। মোগল আধিপত্য বিস্তার ও সুদৃঢ় করার ব্যাপারে সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত দুর্গটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। হাজীগঞ্জ দুর্গটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে। এক সময় দুর্গটি খিদিরপুর দুর্গ নামে পরিচিত ছিল। কথিত আছে শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র ও ধলেশ্বরী_ তিনটি নদীর মিলনস্থল ছিল দুর্গটির খুব কাছে। সেকালে সামরিক কৌশলের দিক দিয়েও দুর্গটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণেই দুর্গ স্থাপনের জন্য এটি ছিল উপযুক্ত স্থান। পাঁচ কোণাকারে নির্মিত এ দুর্গের বাহুগুলো এক মাপের নয়। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দুর্গটির আয়তন আনুমানিক ২৫০ বাই ২০০ ফুট। দুর্গের কোণগুলোতে কামান বসানোর জন্য বুরম্নজ নির্মাণ করা হয়েছিল এবং সেগুলো এখনও টিকে আছে। দেয়ালগুলো বেশ উঁচু এবং প্রায় ২০ ফুট পর্যন্ত ব্যাপ্তি।
সমতল প্রাঙ্গণটি ভূমি থেকে সম্ভবত ৫ ফুট নিচু। সৈন্যরা সম্ভবত এখানে তাঁবু ফেলে অবস্থান করত। এ বেষ্টনী দেয়ালের স্থানে স্থানে কামান দাগার জন্য ছিদ্র আছে। আছে দেয়ালসংলগ্ন তৈরি কয়েকটি উঁচু বেদি। দুর্গের এককোণে ইটের তৈরি বড় আকারের একটি চতুষ্কোণ বেদি আছে। দুর্গের ভেতরে কোন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ নেই এবং ছিল বলেও মনে হয় না। বিশেষ্ণজ্ঞদের ধারণা, দুর্গটিতে কেউ নিয়মিত বসবাস করত না। 
এটি কে নির্মাণ করেছেন তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। মুন্সি রহমান আলী তাঁর এক গ্রন্থে লিখেছেন, মীর জুমলা দুর্গটি নির্মাণ করেন। অন্যদিকে আহম্মাদ হাসান দানি তার 'মুসলিম আর্কিটেকশ্চার ইন বেঙ্গল' গ্রন্থে বলেছেন, ইসলাম খান ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করার পর এটি নির্মাণ করেন। তাছাড়া দুর্গে কোন শিলালিপি না থাকায় বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ইতিহাস থেকে জানা গেছে, মোগল সুবেদাররা তাদের চিরশত্রম্ন ও বাংলার বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করার উদ্দেশে এ দুর্গ ব্যবহার করত। আরাকানি (মগ), পতর্ুগীজ জলদসু্যরা ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় আক্রমণ করে লুটতরাজ ও শান্তি ভঙ্গ করত। তাদের আক্রমণ প্রতিহত করাও ছিল এ দুর্গের প্রধান উদ্দেশ্য। 
দুর্গের দক্ষিণ কোণে একটি উঁচু মানমন্দির (অবজারভেটরি) ছিল। সেটা এখন চেনাই মুশকিল। ভেঙ্গে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। শত্রম্নপক্ষের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য এটি নির্মিত করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উত্তর দিক থেকে একটি আয়তাকার ফটকের মধ্য দিয়ে বেশ ক'টি সিঁড়ির ধাপের ওপর দিয়ে দুর্গের প্রবেশপথ। দুর্গের ভেতরে উন্মুক্ত প্রানত্মরে নামার জন্য আট ধাপের সিঁড়ি রয়েছে। ঢাকা লালবাগ দুর্গ মসজিদের দরজার মতো হাজীগঞ্জ দুর্গের ফটক খিলান সংযোজিত অর্ধগম্বুজের অন্তঃস্থলে অবস্থিত। 
গলির ভেতরে ঢুকতে একটু খারাপ লাগলো। দুর্গের বাইরের দিকে প্রাচীর ঘেঁষে ময়লার স্তুপ জমে আছে, বুঝলাম এটা ময়লার ভাগার। হাসবো, না কাঁদবো! যাই হোক মূল ফটকের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। একটি গোলাকার মাঠের চারিদিকে অন্যান্য দুর্গসমূহের ন্যায় প্রাচীর রয়েছে, চারদিকে রয়েছে প্রহরী কাঠামো। (এইগুলোতে দেখলাম স্কুল কলেজের ছেলেদের আড্ডা, সাথে বিশেষ কিছু.........)। একপাশে রয়েছে একটি ছোট দেয়াল ঘেরা জায়গা, খোঁজ নিয়ে জানলাম এখানে একটি সুড়ঙ্গপথ ছিল। চারপাশে কেমন নীরবতা, এর মাঝে ছবি তুললাম কিছু।
ঘড়িতে যখন দুপুর একটা তখন বের হলাম দুর্গ থেকে, বের হয়ে রওনা দিলাম নারায়ণগঞ্জ ১নং রেলগেটের দিকে রিকশা করে, উদ্দেশ্য বিখ্যাত “বোস কেবিন”। নারায়ণগঞ্জের ‘কফি হাউস’ খ্যাত বোস কেবিন, শহরের চেম্বার রোডে এর অবস্থান। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফলপট্টিতে। ১৯৮৮ সালে স্থানান্তরিত হয় নিজস্ব জায়গায় চেম্বার রোডে। কিন্তু বোস কেবিনের আড্ডাটা আজও আছে, এখনও এক প্রিয়নাম আড্ডাপ্রিয় মানুষের কাছে। গত একানব্বই বছর ধরে বোস কেবিন দাঁড়িয়ে আছে আপন স্বাতন্ত্র্য নিয়ে। প্রতিদিন ভিড় জমে আড্ডাপ্রিয় মানুষের। সময় কাটে ধূমায়িত চায়ের কাপের সঙ্গে তুমুল আড্ডায়।
এই বোস কেবিনের চা পাণ করেছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস; ১৯৩১ সালের ৭ নবেম্বর সুভাষ চন্দ্র বসু নারায়ণগঞ্জে এসে পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন এবং থানায় বসে তিনি ভুলু বাবুর বোস কেবিনের চা পান করেন। কড়া লিকারের এক কাপ চা মুখে দিতেই তৃপ্তিতে তার মন ভরে যায়। ক্লান্তি মুছে যায় তার শরীর থেকে। সুভাষ বসু আশীর্বাদ করেন নৃপেন চন্দ্র বোস ওরফে ভূলু বাবুকে। এর পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হকের মতো নেতারা নারায়ণগঞ্জে আসলে বোস কেবিনের বিখ্যাত চা, কাটলেট কিংবা বাটারটোস্ট না খেয়ে কখনও ফিরতেন না। দেশবরেণ্য অনেক রাজনীতিক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার- যাঁরা বিভিন্ন সময় নারায়ণগঞ্জে এসেছেন, তাঁদের পা পড়েছে বোস কেবিনে। কাটিয়েছেন কিছুটা সময়। বোস কেবিনে পৌঁছে শুনি বিখ্যাত বোস কেবিনের চা এখন পাওয়া যাবেনা। কিছুই খাবো না তা কি করে হয়, শেষে মাটন কাটলেটের অর্ডার দিলাম। কাটলেটটি মোটেও ভালো লাগেনি। যাই হোক দুপুর দুইটার মধ্যে হাজির হলাম কলিগের অনুষ্ঠানে। 

ভ্রমণকালঃ ৩০ আগস্ট, ২০১৩



আগের পর্ব

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ