৩ দিন পর প্রফেশনাল এক্সাম। তাই অফিস থেকে ফিরে পড়তে বসার চেষ্টা করি। দিন কয়েক আগে রাতের বেলা হাতে একটা ফটোকপি শিট নিয়ে বসে বসে টেলিভিশন দেখছিলাম। পরদিন ছুটি, ভেবেছিলাম সারাদিন পড়ব। কিন্তু মনে পড়ল আগামীকাল অফিসের এক কলিগের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে হবে সেই নারায়ণগঞ্জ। মেজাজটা প্রচণ্ড খারাপ হল। প্রতিবার এক্সামের আগেই আমার কোন না কোন একটা ঝামেলা আসবে। এই সব ভাবছি আর চেয়ে আছি টিভি স্ক্রিনের দিকে। হঠাৎ মনে হল আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়? যেহেতু পড়া হচ্ছেইনা, কাল সকালে খুব আর্লি বের হয়ে কেননা চলে যাই সোনারগাঁ পানাম সিটি আর লোকশিল্প জাদুঘর দেখতে। যেই ভাবনা সেই কাজ। নোট রেখে মোবাইল ফোনটা হাতে নিলাম। বাল্যবন্ধু, চির ভবঘুরে (ভ্রমণ পিপাসু অর্থে) মনাকে ফোন দিলাম। তার সাথে কথা বলে ঠিক হল ট্যুর প্রোগ্রাম ঠিক করলাম। জীবনে এই প্রথম সম্পূর্ণ একা কোন ট্যুরে বের হব। ঠিক করলাম প্রথমে পানাম সিটি দেখে ঢুকে পড়ব লোকশিল্প জাদুঘরে। সেটা দেখে চলে যাব হাজীগঞ্জ দুর্গ’র উদ্দেশ্যে।
হাজীগঞ্জ দুর্গ দেখে যাব বিখ্যাত বোস কেবিনে চা খেতে। চা খেয়ে হাজিরা দিব কলিগের প্রোগ্রামে। রাত এগারোটার দিকে মনার বাসায় গিয়ে তার লুমিক্স ক্যামেরাটি নিয়ে আসলাম। সে বলল প্রায় নব্বইভাগ চার্জ আছে ব্যাটারিতে, তারপরও ব্যাটারিটা পূর্ণ চার্জ করার নিমিত্তে ব্যাটারিটা ক্যামেরা হতে খুলে চার্জারে ভরে দিয়ে ঘুমুতে গেলাম। ও হ্যাঁ, সাথে মোবাইলটাকেও চার্জে দিলাম। কারন একাকী এই ট্যুরে গান শুনতে শুনতে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলব এই হল প্ল্যান।
পরদিন সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। জীবনে এই প্রথম সম্পূর্ণ একা কোন ট্যুরে যাচ্ছি। আমি মূলত দলপ্রিয় মানুষ, সর্বদা দলে ঘুরতে পছন্দ করি। প্রায় একযুগ আগে একবার সর্বনিম্ন তিনজন মিলে ট্যুর দিয়েছিলাম মহাস্থানগড়-পাহাড়পুর। সেই ট্যুরের গল্প খুব শিঘ্রই একদিন লিখব আশা করি। যাই হোক ব্যাকপ্যাকে ক্যাপ, সানগ্লাস, পানির বোতল, ক্যামেরা, হেডফোন ইত্যাদি ভরে নিয়ে যখন ঘর থেকে বের হলাম ঘড়িতে তখন প্রায় পৌনে আটটা। রিকশা নিয়ে গুলিস্তান পৌঁছে রাজধানী হোটেলে দ্রুত নাস্তা শেষ করে যখন চায়ের কাপ শেষ করলাম তখন বাজে সোয়া আটটা। ইচ্ছে ছিল আটটার গাড়ী ধরার। যাই হোক মাওলানা ভাসানি হকি স্টেডিয়ামের কাছ হতে স্বদেশ পরিবহনের গাড়ীতে রওনা হলাম মোগড়াপাড়ার উদ্দেশে। টিকেটের মূল্য ৩৫ টাকা নিল। (পরিচিত একজন আমার ভ্রমণ বিষয়ক লেখা পড়ে অভিযোগ করল যে, আমার লেখায় রুটের বিবরণ, থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের খরচ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য থাকেনা। তাই টাকার হিসেবগুলো এবং পরিবহণের কথা উল্লেখ করা)। যাত্রাবাড়ীর ঐতিহাসিক জ্যামে পড়লাম যথারীতি।
গাড়ী যখন কাঁচপুর পার হচ্ছে তখন হঠাৎ মনে হল আচ্ছা আমি কি ক্যামেরায় ব্যাটারিটা ভরেছিলাম? দ্রুত ব্যাকপ্যাকটা খুলে ক্যামেরার ব্যাগ হতে ক্যামেরাটি বের করে চেক করলাম, বিধিবাম! ব্যাটারি আনি নাই! মেজাজটা খারাপ হল, কেমন লাগছিল বুঝতেই পারছেন। দ্রুত মোবাইল হতে হেডফোন খুলে ফেললাম। মোবাইলের চার্জ অর্ধেকের একটু বেশী আছে। মাত্র ৩ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা মোবাইলে, রেজুলেশনও খুব কম। এখন এই ক্যামেরাই ভরসা। মোগড়াপাড়া নেমে হাতের বাম দিকের রোড হতে একটি রিকশা নিলাম সরাসরি পানাম বাজারের উদ্দেশে, ভাড়া নিল ত্রিশ টাকা। রিকশা যখন পানাম নগরী পার হচ্ছিল খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। সারি সারি একতলা, দ্বিতল প্রাচীন ভবন তার প্রত্নতাত্ত্বিক অবকাঠামো নিয়ে দারিয়ে আছে জনমানুষহীন হয়ে। পানামনগরীর আগে পরে লোকালয় রয়েছে। পানাম বাজারে রিকশা হতে নেমে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম, অর্থাৎ এইমাত্র যে পথ দিয়ে এসেছি সে পথে।
পানাম নগর নারায়ণগঞ্জ জেলার, সোনারগাঁতে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর। সোনারগাঁর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে। ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনাগাঁওয়ে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেতো মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়তো পালতোলা নৌকা। প্রায় ঐসময়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠে পানাম নগরী। শহরটিতে ঔপনিবেশিক ধাঁচের দোতলা এবং একতলা বাড়ি রয়েছে প্রচুর। যার বেশিরভাগ বাড়িই ঊনবিংশ শতাব্দির (১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের নামফলক রয়েছে)। মূলত পানাম ছিলো হিন্দু ধনী ব্যবসায়ীদের বসতক্ষেত্র। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিলো ঢাকা-কলকাতা জুড়ে। তারাই গড়ে তোলেন এই নগর। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মোঘলদের সোনারগাঁ অধিকারের পর সড়ক ও সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানী শহরের সাথে পানাম এলাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। পানাম পুল (বিলুপ্ত), দুলালপুর পুল ও পানামনগর সেতুর অবস্থান ও তিনদিকের খাল-বেষ্টনী থেকে বোঝা যায় পানাম, সোনারগাঁর একটা উপশহর ছিলো।
পানাম নগরীর পরিকল্পনাও নিখুঁত। নগরীর পানি সরবাহের জন্য দুপাশে ২টি খাল ও ৫টি পুকুর আছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে কুয়া বা কূপ। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে করা হয়েছে খালের দিকে ঢালু। প্রতিটি বাড়ি পরস্পরের থেকে সম্মানজনক দূরত্বে রয়েছে। নগরীর যাতায়াতের জন্য রয়েছে এর একমাত্র রাস্তা, যা এই নগরীর মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এপাশ-ওপাশ। লাল ইট-মাটির সংমিশ্রণে তৈরি প্রতিটি দালানের নিকট যখন দারিয়ে দেখছিলাম, ছবি তুলছিলাম তখন বারবার মনে হচ্ছিল এই বাড়িগুলোতে একসময় কত মানুষের কোলাহল ছিল, কিছু বাড়ির নকশা এবং অবকাঠামো দেখে বুঝা যায় কোন এককালের কোন এক সন্মভ্রান্তের আবাসালয় এটি। কল্পনায় বারবার দেখার চেষ্টা করেছি সেই সময়কার পানামনগর।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পানামে কাটিয়ে হাঁটা শুরু করলাম সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরের উদ্দেশে।
মন্তব্যসমূহ