জাদুঘর শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে আসা, অর্থ মায়াজাল। উর্দুতে জাদুঘরকে বলা হয় আজবখানা। অতীতে জাদুঘর আজবখানা ছিল কি না জানা না গেলেও বর্তমানে এর অর্থ ব্যাপক। আর জাতীয় জাদুঘরের অর্থ তো আরো বিস্তৃত। জাতীয় জাদুঘর কোনো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, কৃষ্টি, সংগ্রাম ও সংস্কৃতির নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে নিরাপদ পরিবেশে প্রদর্শনের জাতীয় প্রতিষ্ঠান।
বিশ্বের প্রথম জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। ভারতবর্ষে জাদুঘরের ধারণা আসে ইংরেজদের মাধ্যমে। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যরা ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৮১৪ সালে কলকাতায় তাদের উদ্যোগে প্রথম জাদুঘর 'এশিয়াটিক সোসাইটি মিউজিয়াম' প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এর নামকরণ হয় ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম। পূর্ববঙ্গে প্রথম জাদুঘর 'বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর' প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১০ সালে দিঘাপতিয়ার রাজকুমার শরৎ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায়। কলকাতায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রায় এক শ বছর পরে ঢাকায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। আসুন জেনে নেই ঢাকা শহরের যত জাদুঘরসমূহের আদ্যোপান্ত:
(১) জাতীয় জাদুঘরঃ ১৯১২ সালে লর্ড কারমাইকেল ঢাকা সফরে এলে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁর কাছে ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। ঢাকাবাসীর এ দাবির প্রেক্ষিতে ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট ঢাকা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা হয়। সেদিন লর্ড কারমাইকেল তৎকালীন সচিবালয়ের একটি কক্ষে (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন এবং বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল) ঢাকা জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট ঢাকা জাদুঘর প্রথমবারের মতো দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ১৯১৫ সালে এ জাদুঘর নিমতলীর বারোদুয়ারিতে স্থানান্তর হয়। এরপর থেকে জাদুঘরে নিদর্শন সংগ্রহে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় এ জাদুঘরে নিদর্শন সংগ্রহ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার। ১৯৬৬ সালে শাহবাগে ঢাকার কেন্দ্রীয় জাদুঘর নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। ঢাকা জাদুঘরকে একটি স্বায়ত্তশাসিত এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ১৯৭০ সালে ঢাকা মিউজিয়াম (বোর্ড অব ট্যাস্টিজ) অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করা হয়। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় জাদুঘর নির্মাণের প্রয়োজনটা আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শাহবাগের নবনির্মিত ভবনে জাতীয় জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা জাদুঘরের সংগৃহীত নিদর্শনগুলো জাতীয় জাদুঘরে স্থানান্তর করা হয় তখন। একই সঙ্গে সারা দেশ থেকে নিদর্শন সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এভাবে নিদর্শনের সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৬ হাজারে।
প্রায় সাড়ে আট একর পরিমাণ জমির ওপর গড়ে ওঠা চারতলাবিশিষ্ট এ ভবনে নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য রয়েছে ৪৫টি গ্যালারি। দোতলা, তিনতলা ও চারতলায় অবস্থিত এ গ্যালারিগুলোতে ৩০ হাজার নিদর্শন উপস্থাপিত আছে। বাকি নিদর্শনগুলো আছে গুদামজাত অবস্থায়। পালা করে এসব নিদর্শন গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়।
ঠিকানা
শাহবাগ, ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ।
ফোন নম্বর- ৮৬১৯৩৯৬-৯৯, ৮৬১৯৪০০,
ফ্যাক্স- ৮৮ ০২ ৮৬১৫৫৮৫,
জিপিও বক্স নম্বর- ৩৫৫।
ই-মেইল- dgmuseum@yahoo.com
ওয়েবসাইট- http://www.bangladeshmuseum.gob.bd
সময়সূচী
• গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) শনিবার-বুধ (সকাল ১০.৩০ টা থেকে বিকাল ৫.৩০ টা পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত।
• শীতকালীন (অক্টোবর থেকে মার্চ) শনিবার-বুধ (সকাল ১০.৩০ মিনিট থেকে বিকাল ৫.৩০ মিনিট পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।)
• রমজান মাসে: শনিবার-বুধবার (সকাল ৯.৩০ মিনিট থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।)
• বৃহস্পতিবার এই জাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধ। রমজান মাসে বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার সাপ্তাহিক বন্ধ।
টিকেট
• দেশী দর্শনার্থীদের জন্য এটি ১০ টাকা।
• ৩ থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য টিকেটের মূল্য ১০ টাকা।
• SAARC দেশী দর্শনার্থীদের জন্য টিকেট ৩০০ টাকা।
• বিদেশী দর্শনার্থীদের জন্য টিকেট ৫০০ টাকা।
• পহেলা বৈশাখ, ২৬ শে মার্চ ও ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে শিশু ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ পায় এখানে।
(২) মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরঃ ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ সেগুনবাগিচার একটি সাবেকী ভবন ভাড়া নিয়ে যথাযথ সংস্কার শেষে দ্বার উদঘাটন হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। আটজন ট্রাস্টির উদ্যোগে ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপনের এই প্রয়াস গোড়া থেকেই ব্যাপক মানুষের সমর্থন ও সহায়তায় ধন্য হয়েছে। বর্তমানে জাদুঘরের সীমিত পরিসরে প্রায় ১৪০০ স্মারক প্রদর্শিত হলেও সংগ্রহভাণ্ডারে জমা হয়েছে ১৫,০০০-এরও বেশি স্মারক।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিরপুরে মুসলিম বাজার ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি খননের কাজ সম্পন্ন করে এবং পরে (২০০৮ সালে) জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিপীঠ নির্মাণ করে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের রয়েছে গ্রন্থাগার ও তথ্য ভাণ্ডার এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল সেন্টার। হৃদয় আলোড়িত করা জাদুঘর-প্রদর্শনী ও বিভিন্নমুখি কর্মতৎপরতা দ্বারা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিণত হয়েছে দেশে-বিদেশে নন্দিত প্রতিষ্ঠানে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আন্তর্জাতিক জাদুঘর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব সাইট্স্ অব কনসান্স-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব মিউজিয়ামের সদস্য। আইকম-বাংলাদেশের সদস্য।
ভাড়া বাড়িতে জাদুঘরের কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় স্থান-স্বল্পতার কারণে সংগৃহীত স্মারকসমূহ যথাযথভাবে প্রদর্শন করা সম্ভব না হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় জাদুঘর ট্রাস্টের অনুকূলে ০.৮২ একর ভূমি বরাদ্দ দেয়। নভেম্বর ২০০৯-এ উন্মুক্ত স্থাপত্য নকশা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জুরিবোর্ড মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থাপত্য-নকশা নির্বাচন চূড়ান্ত করে। ২০১১ সালের ৪ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন। ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্ভোধন করেন। ১০২ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এই নয়তলা ভবন।
প্রায় দুই বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত এই ভবনের ব্যবহারযোগ্য আয়তনের পরিমাণ ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট। নতুন ভবনে ছয়টি গ্যালারি রয়েছে। জাদুঘর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান গ্যালারিতে নিদর্শন উপস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে। গ্যালারিগুলো ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায়। প্রথম গ্যালারিতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কালপর্বে এই জনপদের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রত্ননিদর্শন রয়েছে। দ্বিতীয় গ্যালারিতে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ঘটনা থেকে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী সরকার গঠন পর্ব পর্যন্ত রয়েছে। এই গ্যালারিতে শব্দ ও আলোর প্রক্ষেপণের একটি বিশেষ প্রদর্শনী আছে। এতে ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বর্বরতা তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া স্বাধীনতার ঘোষণা, ৪ এপ্রিল কুষ্টিয়ার যুদ্ধ এবং সারা দেশের গণহত্যার নিদর্শন রয়েছে এই গ্যালারিতে। আরো রয়েছে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া বাঙালিদের শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাত্রা, সেখানে আশ্রয়, জীবনযাপনের ঘটনাবলি। চতুর্থ গ্যালারিতে বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালির প্রতিরোধ গড়ে তোলার নিদর্শন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, গণমানুষের দুরবস্থা, যৌথ বাহিনীর অভিযান, বিভিন্ন অঞ্চলে বিজয়, বুদ্ধিজীবী হত্যা, ঢাকায় পাকিস্তানি দখলদারদের আত্মসমর্পণ—এই ক্রমানুসারে সাজানো হয় শেষ গ্যালারিটি। বাছাই করা নিদর্শন গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের পুরো ঘটনা। বাকিগুলো সংরক্ষিত রয়েছে জাদুঘরের আর্কাইভে। ভূগর্ভে রয়েছে তিনটি তলা। ওপরের ছয়টি তলায় অফিস মিলনায়তন, পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, ক্যানটিন, প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে। শিখা অনির্বাণ রয়েছে প্রথম তলায়।
ঠিকানা
এফ-১১/এ-বি, সিভিক সেক্টর, আগারগাঁও, ঢাকা-১২০৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন- ০২-৪৮১১৪ ৯৯১-৩(PABX), ০৯৬১১৬৭৭২২৩
ফ্যাক্স- +৮৮০২-৯১৪২৭৮০
ই-মেইল: mukti.jadughar@gmail.com
ওয়েব সাইট- http://www.liberationwarmuseumbd.org/
টিকেট
• জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হয় ২০ টাকায়। পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা বিনামূল্যে যাদুঘরে প্রবেশ করতে পারে।
সময়সূচী
• গ্রীষ্মকালীন: সোমাবার থেকে শনিবার সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
• শীতকালীন: সোমাবার থেকে শনিবার সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
• রবিবার জাদুঘর বন্ধ থাকে।
(৩) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্মৃতি জাদুঘরঃ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের যে বাড়িতে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন, স্বাধিকারের সংগ্রামে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, সে বাড়িটি আজ তাঁর নানা স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। বর্তমানে এটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। ১৯৬১ সালের ১ লা অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের এই বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচন, ১৯৭১ এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন, এই সবগুলো ক্ষেত্রেই শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনা প্রনয়ন, দলের নেতা-কর্মীদের সাথে মতবিনিময়, সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা শোনা এই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি। দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা এই বাড়িতে ভিড় করেছেন ৭১ এর উত্তাল দিনগুলোতে।
“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” – ৭ই মার্চের বিখ্যাত সেই ভাষণের রুপরেখাটি বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছিলেন এখানকার কনফারেন্স টেবিলে বসে। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি তখনও তিনি এই বাড়িটি থেকে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনা করতে থাকেন। এই বাড়ি থেকে অসংখ্যবার পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সর্বশেষে গ্রেপ্তার করেছিল ৭১ এর ২৫ শে মার্চ রাতে। বলা হয়ে থাকে তিনি ধরা দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন তাঁকে না পেলে এই সৈন্যরা নিরস্ত্র জনগণের উপর নারকীয় তান্ডব চালাবে। আর এই বাড়িতেই তাঁকে স্বপরিবারে প্রাণ দিতে হয়েছিল ১৯৭৫ এর ১৫ ই আগষ্ট।
১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে বাড়িটি হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা বাড়িটিকে জাদুঘরে রুপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বাড়িটিকে জাদুঘরে রুপান্তরিত করে এবং নাম দেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। কয়েক ধাপে জাদুঘরটির উন্নয়নকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। প্রথম এবং বর্তমান পর্যায়ে একতলায় দুটি এবং দ্বিতীয় তলায় তিনটি কক্ষ জাদুঘরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও কক্ষযুক্ত হবে। মূল ভবনের পেছনে চার তলা একটি ভবন নির্মানের কথা রয়েছে জাদুঘরের জন্য। নতুন ভবনে একটি লাইব্রেরী ও অডিটোরিয়াম রয়েছে। তবে এখনো চালু করা হয়নি।
জাদুঘর ভবনটিতে ঢুকে এক তলাতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। একতলায় জাদুঘরটির প্রথম কক্ষে ছবির মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে বলা যায়। সেই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলাপচারিতা ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের আলোকচিত্র রয়েছে এখানে। এই কক্ষটি ছিল ড্রইং রুম। যেখানে বসে বঙ্গবন্ধু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে বৈঠক করেছেন। এই কক্ষের পাশের কক্ষটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পড়ার ঘর। এখানে বসে তিনি লেখালেখিও করতেন। এখান থেকেই তিনি ৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় এখনো চোখে পড়বে সেই রাতের তান্ডবলীলার নিদর্শন। এছাড়া এখানে শিল্পীর তুলিতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ অবস্থার একটি প্রতিকৃতি রয়েছে।
দোতলায় গিয়ে প্রথমেই যে কক্ষটি পাওয়া যায় সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর বাসকক্ষ। এর পরের প্রথমে কক্ষটি ছিল তাঁর শোবার ঘর, তারপরের কক্ষটি কক্ষটি শেখ রেহানার শোবার ঘর। এ কক্ষগুলোয় এখন প্রদর্শিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারবর্গের নানা স্মৃতি চিহ্ন। এটি কেবল একটি পারিবারের স্মৃতি চিহ্ন নয়। এগুলো একটি জাতির ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
এখানে থাকা বিভিন্ন প্রদর্শন সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে শেখ রাসেলের খেলার জিনিস। যেমন- বল, হিকষ্টিক, ব্যাট, হেলমেট, সুলতানা কামালের সঙ্গে তার ছবি ইত্যাদি। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ব্যবহৃত পাইপ, চশমাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তো রয়েছেই। আরও নিদর্শন প্রদর্শনীর জন্য আনার কথা রয়েছে।
ঠিকানা
বঙ্গবন্ধু ভবন, বাড়ি# ১০, রোড# ৩২ (পুরাতন), ১১ (নতুন)।
ফোন- ৮৮-০২-৮১১০০৪৬
ফ্যাক্স- ৮৮-০২-৮৩১৩৮৬৬
টিকেট
• টিকেটের মূল্য ৫ টাকা।
• ৩ বছরের কম বয়সীদের কোন টিকেট লাগে না। .
• শুক্রবার ১২ বছরের কমবয়সীদের কোন টিকেট লাগে না।
• টিকেট কাউন্টার প্রথম দরজার পশ্চিম পাশে অবস্থিত।
সময়সূচী
• সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে।
• জাদুঘরটির সাপ্তাহিক বন্ধ বুধবার।
• শুক্রবার ও শনিবার ভিড় বেশি হয়।
(৪) সামরিক জাদুঘরঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনী অগ্রণী ভূমিকা রাখে। আবহমান বাংলার চিরাচরিত সামগ্রিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এ দেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্য আর উন্নয়নের ক্রমবিকাশ সংরক্ষণ ও প্রচার করার জন্য ১৯৮৭ সালে ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসের প্রবেশদ্বারে স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর। সামরিক জাদুঘরের গুরুত্ব এবং দর্শকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে সামরিক জাদুঘরটি ১৯৯৮ সালে নগরের গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রস্থল বিজয় সরণিতে স্থাপন করা হয়।
জাদুঘরে সীমানা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে ট্যাংক পিটি-৭৬। রাশিয়ার তৈরি এই ট্যাংকটি পানিতেও ভেসে চলতে সক্ষম। এই ট্যাংকটি ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকা থেকে বাংলাদেশ বাহিনী কর্তৃক পাকিস্তান দখলদারবাহিনীর নিকট হতে উদ্ধার করা হয়। সৌজন্যে এরিয়া সদরদফতর, কুমিল্লা। ট্যাংক পিটি-৭৬ ছাড়াও সামরিক জাদুঘরের মাঠের উত্তর ও পূর্ব দিক দিয়ে সুসজ্জিতভাবে আরো ১৬টি ট্যাংক ও কামান প্রদর্শিত হচ্ছে। এগুলো খোলা আকাশের নীচে কেবল পাকাভিটি করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ মি. মি. প্যাক হাউগান, ট্যাংক ক্রুইজার আর এ এম জিপিও সেক্সটন, ট্যাংক এ আর ভি মার্ক-টু শেরমান এম-৩২ বি-১, ট্যাংক ক্রুইজার মিডিয়াম ৭৬ মি. মি. গান মার্ক-টু শেরমান, মোটর গ্যারেজ ৪০ মি. মি. সাপোর্ট ক্রুইন এম ১৯ এ১, ১৭ পাউন্ডার ট্যাংক বিধ্বংসী গান, ২৫ পাউন্ডার গান, এস পি আর্টিলারী ২৫ পাউন্ডার সেঞ্জটন এম-৫ এবং ৩৭ মি. মি. কামানসহ ট্যাংক হালকা স্টুয়ার্ড মার্ক-৪ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৌজন্যে প্রাপ্ত বলে পরিচিতি পর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও উন্মুক্তভাবে জাদুঘর মাঠের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে সারিবদ্ধভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার ১০৫/৫২ সি এম ক্রুপ গান, ১৯৭৩ সালে মিসর কর্তৃক আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ব্যবহৃত ব্যারেল ১০০ মি. মি. ট্যাংক গান এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ৬টি ছোট-বড় কামান। মাঠের উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রদর্শিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত জাপানের অনুদানকৃত মোটর লঞ্জ ‘এম এল সূর্যোদয়'। এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মূল জাদুঘর ভবনের দোতলায় রয়েছে ৮টি গ্যালারি। প্রথম গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে হাতকুঠার, তীর, ধনুকসহ আদিম যুগের অস্ত্রশস্ত্র। দ্বিতীয় গ্যালারিতে ডিবিবিএল গান, এসবিবিএল গান, বিশেষ ব্যক্তিবর্গের ব্যবহৃত হাতিয়ারসহ যুদ্ধাস্ত্র; তৃতীয় গ্যালারিতে এলএমজি, এসএমজিসহ মাযারি অস্ত্র এবং চতুর্থ গ্যালারিতে মর্টার, স্প্যালো, এইচএমজিসহ ভারী অস্ত্র সর্বসাধারণের জন্য প্রদর্শন করা হচ্ছে। পঞ্চম গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে সশস্ত্রবাহিনীর শীত ও গ্রীষ্মকালীন পোশাক-পরিচ্ছদ, র্যাংক, ব্যাজ, ফিতা ইত্যাদি। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিল, সেক্টর কমান্ডারগণের পোর্ট্রেট, কিছু ব্যবহার্য বস্তু ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধ' শীর্ষক ৬ষ্ঠ গ্যালারিতে। সপ্তম গ্যালারিতে নাম দেয়া হয়েছে ‘বিজয় গ্যালারি'। এতে সশস্ত্রবাহিনীর যেসব ব্যক্তি মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন সেসব বীরশ্রেষ্ঠদের পোর্ট্রেট ও সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অষ্টম গ্যালারিতে রয়েছে প্রাক্তন সকল সেনাপ্রধানের তৈলচিত্র, বীরশ্রেষ্ঠ-বীরপ্রতীকদের নামীয় তালিকা ইত্যাদি।
একমাত্র জাদুঘর ভবনের নীচতলায় প্রদর্শিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী যে গাড়িটি নিয়ে বিভিন্ন যুদ্ধ এলাকা পরিদর্শন করেন সেই জিপ গাড়িটি। ‘যশোর ব ১৪৬' নম্বরধারী এই গাড়িটির স্ট্যান্ডবোর্ডে বলা হয়েছে, এটি ১/৪ টন ৪*৪ কাইজার উইলিজ জিপ ওয়াগানার। এটি যশোর শিক্ষা বোর্ডের সৌজন্যে প্রাপ্ত। এর পাশপাশি রয়েছে গোলন্দাজবাহিনী কর্তৃক ব্যবহৃত ১৪.৫ মি. মি. কোয়াড বিমান বিধ্বংসী কামান, ১২০ মি. মি. মর্টার ব্রান্ডেট এ এম-৫০, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর ব্যবহৃত ৬ পাউন্ডার ট্যাংক বিধ্বংসী কামান, ১০৬ মি. মি. রিকয়েললেস রাইফেল (আর আর)সহ জিপ জি এস-উইলিস ৪/৪ মডেল এম ৩৮ এ-১ ইত্যাদি। সামরিক জাদুঘরের নীচ তলায় পশ্চিম পাশের কক্ষে একাংশে সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে মুজিব কর্নার। এখানে স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ৩০টি আলোকচিত্র অঙ্কিত আছে। সামরিক জাদুঘরের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ায় নীচ তলায় পূর্ব প্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে টাচপেট কর্নার। জাদুঘরের আরেক আকর্ষণ হলো পাক সেনাবাহিনী থেকে উদ্ধারকৃত স্টাফ কার মার্সিডিজ বেঞ্জ ও সিলিন্ডার ২০০০ সি সি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট লে. জে. জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এটি ব্যবহার করতেন।
টিকেট ও সময়সূচী
• এই জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কোন টিকেট লাগে না।
• সপ্তাহের পাঁচ দিন শনিবার, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার জাদুঘর খোলা থাকে।
• গ্রীষ্মকালে সকাল ১০.৩০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬.৩০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
• শীতকালে ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
• বুধবার এবং শুক্রবার জাদুঘরটি বন্ধ থাকে।
(৫) ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালাঃ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মরণে এই জাদুঘর। আনুষ্ঠানিক নাম- ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জাদুঘরটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের পশ্চিম পাশে এবং পলাশী মোড়ের উত্তর পাশে অবস্থিত। জাদুঘরটির দক্ষিণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ২০১২ সালের ২৫ মার্চ এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। দ্বিতল এ জাদুঘরটিতে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোয় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মিছিল, সভা ইত্যাদির আলোকচিত্র, ভাষা শহীদদের আলোকচিত্র, প্রিয়জনকে লেখা চিঠি ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে। এছাড়াও আরও বিভিন্ন নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা ভবন প্রাঙ্গন আবুল বরকত এর প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। জাদুঘরটির জন্য একটি লাইব্রেরী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এখানে ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই থাকছে।
(৬) সোহরাওয়ার্দী পাতাল জাদুঘরঃ ১৯৭১ এ পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের স্মৃতি বিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধাকে স্মরণ করার লক্ষ্যে যখন একটি বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়, তখন সংশ্লিষ্ট স্থপতি উদ্যানটির ক্ষতি কমানোর জন্য অধিকাংশ স্থাপনা মাটির নিচে ঢুকিয়ে দেবার পরিকল্পনা করেন। এর ফলশ্রুতিতেই বর্তমান পাতাল জাদুঘর। ভবন প্রাঙ্গনের শুরুতেই রয়েছে প্রবেশপথ এবং শিখা চিরন্তন। এরপর সিড়ি ভেঙ্গে নিচে মূল প্রাঙ্গনে প্রবেশ করতে হয়। ভবনের বায়ে দেয়ালের গায়ের পোড়া মাটির ম্যুরালে অংকন করা দেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস চোখে পড়বে। পাতাল জাদুঘরে প্রবেশের প্রথমই হাতের ডানে রয়েছে অডিও ভিজুয়্যাল রুম, তারপরের প্রথমে বড় খোলা গ্যালারীতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির ছবি ও লিখিত দলিল এবং এখানেই হাতের বামে রয়েছে চমৎকার ওয়াটার ফল।
গ্যালারীতে যাওয়ার পথের দুপাশের দেয়ালে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া নির্যাতনের নর্মম চিত্র। পরের খোলা গ্যালারীতে রয়েছে ডঃ হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানো স্যামুয়েল এম হসকিনসন এর গোপন দলিল। এখানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৩.৩১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যে টেবিলের উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্ঝলের কমান্ডার লেঃ জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খনা নিয়াজী আত্নসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করেন তার একটি অনুকৃতি টেবিল। আরো রয়েছে গোপন বেতার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনার দালিলিক প্রমান এবং সেই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পনের মুহুর্তের বড় একটি ছবি।
সময়সূচী ও টিকেট
• প্রতিদিন বিকাল ৫ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই পাতাল জাদুঘর।
• শুক্রবার ও শনিবার এবং সকল সরকারী ছুটির দিনে জাদুঘরটি বন্ধ থাকে।
প্রবেশ
• শাহবাগের শিশু পার্কের পেছনের রাস্তা থেকেই এই জাদুঘর কমপ্লেক্সের মূল প্রাঙ্গন শুরু।
• বর্তমানে জাদুঘরে বিনা টিকেটে প্রবেশের ব্যবস্থা রয়েছে।
• একক এবং দলভিক্তিক প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।
• জাদুঘরে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য আলাদা পথ ব্যবহার করতে হয়।
(৭) জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরঃ জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সর্বস্তরের প্রযুক্তিকে এদেশে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে আগারগাঁও শেরেবাংলানগরে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। এর আগে ১৯৬৬ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে এদেশে প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক জাদুঘরের যাত্রা শুরু। এটি শুরু হয়েছিল খুব স্বল্প কিছু সংগ্রহ দিয়ে। বর্তমানে এই সংগ্রহশালা বেড়ে হয়ে উঠেছে অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ। ভিতরে ঢুকলে শুরুতেই দর্শকদের চোখে পড়বে নিচ তলাতে ছয় কোনাকার কাচের ঘরে ছাদ থেকে ঝুলছে ৬১ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ২৭ কেজি ভরের ফুকোর দোলক। এর একপাশে অ্যাকুরিয়ামে রয়েছে হরেক রকম রঙিন মাছ। যা দর্শনার্থীদের সমুদ্রের তলদেশে ভ্রমণের আকাঙ্খার জন্ম দেবে। মনে হবে যদি মাছের মত সাঁতরে বেড়ানো যেত সমুদ্রের তলদেশে। মনে পড়ে যাবে কারও কারও রাশিয়ার বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আলেক্সান্দার বেলায়েভের সায়েন্স ফিকশান ‘উভচর মানুষ’-এর কথা, যে মানুষ একই সাথে সমুদ্রের বৈচিত্রপূর্ণ তলদেশে ঘুরতে পারে আবার চাইলে পৃথিবীতেও বাস করতে পারে।
দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য এখানকার সংগ্রহশালাকে বিভিন্ন গ্যালারিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমেই রয়েছে ভৌত গ্যালারি। এই গ্যালারিতে বিজ্ঞানের নানা সূত্রের প্রমাণ দেখানো হয়েছে। রয়েছে নিউটনের প্রথম ও তৃতীয় গতি সূত্রের প্রদর্শনী। এছাড়া এই গ্যালারিটিতে বিভিন্ন সংরক্ষিত জিনিস প্রদর্শনের পাশাপাশি বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের নামে কয়েকটি কর্নার রয়েছে, যেমন- সত্যেন্দ্রনাথ বসু কর্নার, কুদরত-ই-খুদা কর্নার ও আনুশেহ আনসারি কর্নার।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কর্নারে রয়েছে এই মহান বিজ্ঞানীর ব্যবহৃত এক্সরে টিউবের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বিপরীত পাশেই কুদরাত-ই-খুদার কর্নারে আছে তাঁর ব্যবহৃত চশমা, ঘড়ি, কলম, সিল, সিলের প্যাড, পেপার ওয়েট প্রভৃতি। এছাড়া এই গ্যালারিতে আছে বৈদ্যুতিক ঘন্টা, সিনেমাস্কোপ, হ্যালির ধুমকেতুর সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও বর্ণনা, ভাসমান বাগানসহ ভৌত বিজ্ঞানের বিচিত্র বিষয়।
শিল্পপ্রযুক্তি গ্যালারি ও তথ্য প্রযুক্তি গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে সমুদ্রের গভীরতা নির্নয়ের যন্ত্র, পুরাতন গ্রামোফোন, আছে ১৯৬৫ সালে বিটিভির ব্যবহৃত প্রথম ক্যামেরা। আছে একটি ইলেক্ট্রনিক মাইক্রোস্কোপ, যার মাধ্যমে বস্তুর দশ লক্ষ গুন বড় প্রতিবিম্ব দেখা সম্ভব। আছে চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানা, চিনির কল, কর্ণফুলি কাগজ কল এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মডেল, ৬০০ কেজি ওজনের বলাকা বিমানের একটি ইঞ্জিন, যা সোভিয়েত ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিয়েছিল।
শিল্প প্রযুক্তি গ্যালারি থেকে একটু এগুলে সঙ্গেই রয়েছে তথ্য প্রযুক্তি গ্যালারি। এই গ্যালারিতে আছে বিভিন্ন কম্পিউটার। যার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠবে কম্পিউটারের বিবর্তন। এখানে আছে ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে আনা প্রথম এনালগ কম্পিউটার আইবিএম ১৬২০। পরমাণু কমিশন একসময় এটি ব্যবহার করত। এছাড়াও রয়েছে আইবিম ১৪০১, দেখতে অতিকায় আলমারির মতো। এই গ্যালারিতে সংযোজন করা হয়েছে আধুনিক টাচস্ক্রিন কম্পিউটার। যেখানে টাচ করলেই দর্শনার্থীরা দেখতে পান জাদুঘরের সব তথ্য। আছে একটি পুরাতন মুদ্রণ যন্ত্রসহ তথ্য প্রযুক্তির বিচিত্র নিদর্শন।
বিজ্ঞানকে যাদের কাছে মনে হয় নিরস বা কাঠখোট্টা তাদের কথা বিবেচনা করেই জাদুঘরের দ্বিতীয় তলায় রাখা হয়েছে ‘মজার বিজ্ঞান গ্যালারি’ নামে একটি গ্যালারি। এখানে প্রবেশ করলে দর্শনার্থীরা মুখোমুখি হবেন বিচিত্রসব মজার বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের। এখানে রয়েছে মজার কয়েকটি আয়না, যার সামনে দাঁড়ালে নিজের চেহারা কোনটায় বামুন, কোনটায় লম্বা, কোনটায় আবার সঙ্কুচিত দেখায়। আয়নায় এই সমস্ত কর্মকা- দেখে এমনিতেই যে-কারো প্রাণে হাসির উদ্রেক হয়ে যায়। এখানে এমন যন্ত্র আছে যার মাধ্যমে ছায়াকে রঙিন দেখা সম্ভব।
পৃথিবীর বাইরে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি নেই এই নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছে অনেক জল্পনা-কল্পনা, রয়েছে অনেক জিজ্ঞাসা। এছাড়া পৃথিবীতে জীবের উদ্ভবই কিভাবে হলো তা নিয়েও বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্ত নেই। এই জাদুঘরে জীববিজ্ঞানের জন্য রয়েছে আলাদা একটি গ্যালারি। এই গ্যালারিতে ঢুকলে দর্শনার্থীরা দেখতে পাবেন ৪০ ফুট দীর্ঘ এক নীল তিমির কঙ্কাল। এটি বঙ্গোপসাগর থেকে ১৯৮৮ সালে সংগৃহিত। যারা এতদিন যাবৎ বইপুস্তকে তিমির বিশালত্ব সম্পর্কে জেনে এসেছেন বা লোকমুখে শুনেছেন, তাদের মিলবে একটি মাঝারি আকৃতির তিমি কতখানি বিশালাকৃতির হতে পারে তা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ। রয়েছে ১৯৯৬ সালের প্যানজেটিক ডলফিন।
তরুণ বিজ্ঞানীদের উৎসহিত করার জন্য এখানে আছে একটি গ্যালারি। এই গ্যালারিতে তরুণ বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত যেসব প্রকল্প জাতীয় বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সপ্তাহে প্রদর্শিত হয়েছে তাই-ই এই গ্যালারিতে স্থাপন করা হয়েছে। এখানে প্রদর্শীত উল্লেখযোগ্য বস্তুর মধ্যে রয়েছে কাঠ সমতলকরণ মেশিন, রোড ব্যারিয়ার, ম্যাগনিফায়িং গ্লাস গ্রাইন্ডিং মেশিন, এয়ারকুলার, এয়ার ক্লিনারসহ আরও নানা কিছু। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে একটি গ্রন্থগারও আছে। এখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক প্রচুর বই রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক বেশ কিছু এনসাইক্লোপিডিয়া। তাছাড়া রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কম্পিউটার-বিজ্ঞান, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, লাইফ সায়েন্স ইত্যাদি বিষয়ক বই। গ্রন্থগারটি অফিস চলাকালিন সময়ে খোলা থাকে।
মেঘমুক্ত রাতের আকাশ মানেই লক্ষ লক্ষ গ্রহ-নক্ষত্রের মিলনমেলা। তারাভরা ওই আকাশ প্রতিনয়তই আমাদের মনে সৃষ্টি করে নান বিস্ময়ের। বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষমাত্রই ইচ্ছে হয় ওইগুলি সম্পর্কে জানতে, ইচ্ছে হয় যদি সম্ভব হতে ওইগুলিকে আরেকটু ভালভাবে দেখার। সেই ইচ্ছেটাই পূরণ করার তাগাদা থেকে প্রতি শনি ও রবিবার সন্ধ্যা থেকে দুই ঘণ্টা জাদুঘরের ছাদে চাঁদ, শুক্রগ্রহ, মঙ্গলগ্রহ, শনিগ্রহ, এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি, রিংনেবুলা, সেভেন সিস্টার্স, জোড়াতারা আর তারার ঝাঁক দেখানো হয় টেলিস্কোপের সাহায্যে। টেলিস্কোপে এই আকাশ পর্যবেক্ষনে প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা।
এছাড়াও জাদুঘরে রয়েছে একটা সায়েন্স পার্ক। এই পার্কটা কেবল শিশু-কিশোরদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এখানে আছে মিউজিক্যাল টিউব, আর্কিমিডিয়ামের স্ক্রু, সিমপ্যাথেটিক সুইং, সুইং পেন্ডুলামসহ অনেক মজার মজার খেলার ব্যবস্থা।
অবস্থান
জাদুঘরটি আগারগাঁতে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বাংলদেশ অফিসের বিপরীত পাশের রাস্তা দিয়ে বাংলাদেশ বেতার অফিস পার হয়ে উত্তর দিকে জাদুঘরটি অবস্থিত।
সময়সূচী
• শনিবার থেকে বুধবার সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত সকলের জন্য খোলা থাকে।
• সপ্তাহের বৃহস্পতি ও শুক্রবার এবং সকল সরকারী ছুইটির দিনগুলোতে জাদুঘর বন্ধ থাকে।
টিকেট ও কাউন্টার
• মূল ফটকের দক্ষিণ পাশে টিকেট কাউন্টার।
• এখানে জনপ্রতি টিকেট মূল্য ৫ টাকা।
• ৫ বছরের নীচের বাচ্চাদের টিকেট লাগে না।
• এখানে বিনা পয়সায় পরিদর্শনের কোন সুযোগ নেই।
• সূর্য ও চন্দ্র গ্রহনের দিন এই জাদুঘরে দর্শনার্থীর ভিড় বেশী হয়।
(৮) সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরঃ বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শিল্প-বাণিজ্যের মিলনমেলা হিসেবে একসময় সমৃদ্ধশালী ছিল। এ স্থানটিতে আগমন ঘটেছিল বহু দরবেশ, সাধক ও পর্যটকের। তাদের পদচিহ্ন আজও সোনারগাঁওয়ের পথেপ্রান্তরে ছড়িয়ে রয়েছে। অনুপম স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন ও সবুজের সমারোহে এক অপরূপ নৈসর্গিক লীলাভূমি সোনারগাঁও। একটা সময় যখন বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে সোনারগাঁও তার নিজস্ব ঐতিহ্যের স্মৃতিটুকু হারাচ্ছিল, তখন এখানে আগমন ঘটে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের। শিল্পাচার্য স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতায় সোনারগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোকজ ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (সোনারগাঁও জাদুঘর)। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ এক প্রজ্ঞাপনবলে তৎকালীন সরকার সোনারগাঁও পানামনগরে অস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোকজ ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। পরে এটিকে ১৯৮১ সালে পানাম নগরের কাছাকাছি শ্রী গোপীনাথ সর্দার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ১৯৯৮ সালের ৬ মে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ লোকজ ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে (সোনারগাঁও জাদুঘর) দর্শনার্থীদের জন্য মোট ১১টি গ্যালারি রয়েছে। প্রতিটি গ্যালারিতে দুর্লভ সব ঐতিহ্যের নিদর্শন সংরতি আছে। গ্যালারিগুলো হলো নিপুণ কাঠখোদাই গ্যালারি; গ্রামীণ জীবন গ্যালারি; পটচিত্র গ্যালারি; মুখোশ গ্যালারি; নৌকার মডেল গ্যালারি; উপজাতি গ্যালারি; লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শন গ্যালারি; তামা, কাঁসা, পিতলের তৈজসপত্র গ্যালারি; লোকজ অলঙ্কার গ্যালারি; বাঁশ, বেত, শীতলপাটি গ্যালারি ও বিশেষ প্রর্দশনী গ্যালারি। এগুলো ছাড়াও ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে ফাউন্ডেশনে নতুন আরও দুটি গ্যালারি স্থাপন করা হয়। নতুন দুটি গ্যালারিকেই ভিন্নমাত্রায় সাজানো হয়। প্রথমটিতে কাঠের তৈরি প্রাচীন ও আধুনিককালের নিদর্শন দ্রব্যাদি দিয়ে সাজানো হয়েছে। দ্বিতীয়টিতে সোনারগাঁওয়ের ইতিহাসখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা নকশিকাঁথা প্রদর্শনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের বস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া প্রদর্শন করা হয়েছে। তাছাড়া ফাউন্ডেশন চত্বরে রয়েছে দুজন অশ্বারোহী, গরুর গাড়ির ভাস্কর্য ও দৃষ্টিনন্দন লেক। ফাউন্ডেশন চত্বরে কারুপল্লী গ্রাম ও কারুশিল্প গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প নামে দুটি প্রকল্প, লাইব্রেরি এবং ডকুমেন্টশন সেন্টার রয়েছে।
কারুপল্লী গ্রামে ৩৫টি শনের ঘর রয়েছে। সেখানে দেশের নানা অঞ্চলের দ কারুশিল্পীরা বিভিন্ন কারুপণ্য সরাসরি তৈরির পাশাপাশি আগত দর্শনার্থী ও পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। ফাউন্ডেশন চত্বরে সর্বশেষ যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয় তার নামকরণ করা হয় সোনারগাঁও কারুশিল্প গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আবহমান গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের নিজস্ব মেধায় সৃষ্ট শিল্পকলা, লোকজ ও কারুশিল্পের ঐতিহ্যের নিদর্শন সংগ্রহ, সংরণ, প্রদর্শন এবং তার উৎপাদন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামীণ জীবনধারার আলোকে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের আদলে নির্মিত প্রতিটি ঘরে স্থান পায় অঞ্চলভিত্তিক মৃৎশিল্প, কাঠ ও কাঠখোদাই, হাতে তৈরি কাগজ, শাঁখা-ঝিনুক, নারিকেল কারুশিল্পী, জামদানি শাড়ি, তাঁতবস্ত্র, শতরঞ্জি, রেশমবস্ত্র, পাটজাত কারুশিল্প, বাঁশ-বেত কারুশিল্প এবং তামা, কাঁসা ও লোহার কারুশিল্প। আর এ প্রকল্পের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বাংলার বৈচিত্র্যময় রূপ।
লোকজ ও কারুশিল্পের ওপর গবেষণার সুবিধার্থে এখানে লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেন্টার যোগ করা হয়েছে। লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেন্টারটিতে রয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি গবেষণাধর্মী গ্রন্থসহ পত্রপত্রিকা। লাইব্রেরিটি জাদুঘরে আসা সব দর্শনার্থী ও পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ফাউন্ডেশন চত্বরে বছরে দুটি মাসব্যাপী লোকজ উৎসবসহ বিভিন্ন দিবসগুলোতে মেলা উৎসবের আয়োজন করা হয়।
মেলা প্রাঙ্গণে গ্রামীণ বিভিন্ন জীবনযাত্রার আলোকে স্থানীয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে লোকজ জীবন প্রদর্শন এবং স্থানীয়দের অংশগ্রহণে গ্রামীণ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে লাঠিখেলা, হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্দা, ঘুড়ি উড়ানো, পানিতে হাঁস ধরা উল্লেখযোগ্য। লোকজ ও কারুশিল্প মেলা এবং উৎসবকে কেন্দ্র করে লোকজ মঞ্চে দিনব্যাপী আবহমান গ্রামবাংলার চিরাচরিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে। তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লোকজশিল্পীরা জারি-সারি, শরিয়তি-মারফতি, বাউল গান, পালাগান, হাছন রাজার গান, গায়ে হলুদের গান, বৃষ্টির গান, ঘেটু গান, আলকাপ গান, ভাওয়াইয়া গান, গম্ভীরা গান, কবি গান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গান পরিবেশন করেন।
(৯) লালবাগ কেল্লার জাদুঘরঃ বর্গাকৃতির সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা লালবাগ কেল্লার প্রথমেই নজরে আসে বিশাল তোরন/ফটক। সোজা একটু ভেতরেই শায়েস্তা খাঁনের প্রিয় কন্যা পরীবিবির সমাধি সৌধ। লালবাগ কেল্লায় সবচাইতে আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয় যে জিনিসটি আছে তা হল সুবেদার শায়েস্তা খাঁনের বাসভবন ও দরবার হল। বর্তমানে যা লালবাগ কেল্লা জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এই জাদুঘরটিতে শায়েস্তা খানের ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে - হাম্মামখানা, প্রসাধনী কক্ষ, শৌচাগার, পোশাক পরিবর্তনের কক্ষ, গরম পানি ও বাতাস প্রবাহের চুল্লী, চৌবাচ্চা, পানি সংরক্ষনাধার ইত্যাদি। রয়েছে তৎপূর্ব ও তৎকালীন সম্রাট ও শাসকদের শাসনামলে ব্যাবহৃত মুদ্রা উল্লেখ্য সে সময়কার মুদ্রাগুলো বিভিন্ন ধাতব উপাদান দ্বারা তৈরী হত। যেমন: সোনা, রূপা, তামা, সীসা ও লোহার মিশ্রণে। মুদ্রাগুলো আকারে বর্গাকৃতির ও গোলাকার।
এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে তৎকালীন তৈজসপত্র - তৎকালীন ও তৎপূর্ব মানচিত্র, চীনা সঞ্চয়পত্র, গামলা, পারস্যে তৈরী থালা-বাসন ও ট্রে, সুরাহী, শীলা পাথর; অস্ত্রসস্ত্রর মধ্যে রয়েছে মুঘল আমলে যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রসস্ত্রগুলো - ১৭-১৮-১৯ শতকের বর্শামূল, বর্শাফলক, লোহার জালের বর্ম, ছোরা ও খাপ, তীর ও বর্ষা, বর্ম, গুপ্তি, তীর ও বর্ষা নিরোধক লোহার জালের পাত্র, ঢাল, তরবারী, দস্তানা, পারকাশন লক বন্দুক ও রাইফেল, হাতকুঠার, শিরস্ত্রান, বক্ষবর্ম, তীর ধনুক, ফ্লিন্ট লক পিস্তল, ফ্লিন্ট লক কামান, পারকাশন লক পিস্তল, সৈনিকদের পোশাক, রাজার পোশাক এবং সীসার গুলি। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় জিনিসের মধ্যে রয়েছে - ১৭শ শতকের পারস্যে তৈরী তিনটি কার্পেট, ঝারবাতি, ল্যাম্প, জায়নামাজ, সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে একটি মসজিদ ও বাগান তৈরীর বিবরণ লিপিবদ্ধকৃত শিলালিপি। ফারসি ভাষায় লিখিত শিলালিপিটি ১০৯৯ হিজরী ও ১৬৮৯-৯০ খিষ্টাব্দের। আরও রয়েছে মুঘল চিত্রকলা, দুরদানার প্রতিকৃতি, সিংহাসনে বসা জনৈক রাজার প্রতিকৃত, শাহজাদা আযম শাহের প্রতিকৃতি, সিংহাসনে বসা সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতিকৃতি, আসফ শাহ বাহাদুরের প্রতিকৃতি, মধুমতি অঙ্কিত একটি চিত্র, উটের নাচ ও বন্যজন্তুর প্রতিকৃতি ইত্যাদি।
সময়সূচী
• গ্রীষ্মকালীন: ১লা এপ্রিল থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকাল ১০.০০ টা থেকে বিকেল ৬.০০ টা পর্যন্ত। দুপুর ১.০০ টা থেকে ১.৩০ মিনিট পর্যন্ত বিরতি। শুক্রবার: সকাল ১০.০০ টা থেকে ৩.০০ টা পর্যন্ত। ১২.৩০ মিনিট থেকে ২.৩০ মিনিট পর্যন্ত বিরতি।
• শীতকালীন: ১লা অক্টোবর থেকে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত সকাল ৯.০০ টা থেকে বিকেল ৫.০০ টা পর্যন্ত। দুপুর ১.০০ টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বিরতি। শুক্রবার সকাল ৯.০০ থেকে বিকেল পর্যন্ত। দুপুর ১২.৩০ মিনিট থেকে ২.০০ টা পর্যন্ত বিরতি।
• রবিবার পূর্ণ দিবস বন্ধ থাকে ও সোমবার অর্ধ দিবস পর্যন্ত বন্ধ থাকে। এছাড়া সরকারী ছুটির দিনগুলোতে লালবাগ কেল্লা পূর্নদিবস বন্ধ থাকে।
টিকেট ও কাউন্টার
• কেল্লার মূল ফটকের বাইরে দু’পাশে দু’টি কাউন্টার আছে। তার মধ্যে বাম পাশের কাউন্টারটি বন্ধ এবং ডান পাশের কাউন্টারটি খোলা থাকে।
• জনপ্রতি দেশী পর্যটক ও দর্শনার্থী ১০.০০ টাকা
• জনপ্রতি বিদেশী পর্যটক ও দর্শনার্থী = ১০০.০০ টাকা
• ৫ বছর বয়সের নীচে বাচ্চাদের জন্য কোন টিকেট লাগে না।
(১০) আহসান মঞ্জিল জাদুঘরঃ ঢাকার নবাব পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত এই প্রাসাদটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে আহসান মঞ্জিলের মূল প্রাসাদটিতে ২৩টি গ্যালারী রয়েছে। ১৯০৪ সালে তোলা ফ্রিৎজকাপের আলোকচিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন কক্ষ ও গ্যালারীগুলো সাজানো হয়েছে। এখানে নবাবদের ব্যবহৃত উনিশ শতকের সৈনিকের বর্ম, ভবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সংস্কারপূর্ব ও পরবর্তী আলোকচিত্র ও পেইন্টিং, আহসান মঞ্জিল নিলামে বিক্রির জন্য এবং নতুন ভবন তৈরীর নির্দেশ নামা, আলমারী, তৈজসপত্র, ফানুস ও ঝাড়বাতি, প্রাসাদ ডাইনিং রুম, নবাবদের আনুষ্ঠানিক ভোজন কক্ষ, বক্ষস্ত্রান ও শীরস্ত্রান, হাতির মাথার কংকাল (গজদন্তসহ), অলংকৃত দরমা বেড়া/কাঠ ছিদ্র অলংকরন সম্বলিত, দরজার অলংকৃত পাল্লা, ঢাল-তরবারী, বল্লম, বর্শাফলক, স্যার আহসানুল্লাহ জুবিলী মেমোরিয়াল হাসপাতালে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক কিছু সরঞ্জামাদি ও খাতাপত্র, মুসলিম লীগ কক্ষ, সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দর একটি বড় তৈলচিত্র, নবাবদের অবদান ঢাকায় পানীয় জলের ব্যবস্থা, পানির ড্রাম, আইসক্রীম, বালতি, কফি তৈরীর মেশিন, কফির কাপ, কুলফি গ্লাস, পানির ট্যাপ, অলংকৃত বালতি, স্টেট বেডরুম-রাজকীয় অতিথীদের থাকা ও বিশ্রামের জন্য এই বেডরুম, শোবার খাট, আলমারী, ঘড়ি, ড্রেসিং টেবিল, আয়না, তাক, টেবিল-চেয়ার, নওয়াবদের অবদান ঢাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। ঢাকায় বিদ্যুৎ, কেরোসিন বাতি, হারিকেন চুল্লি, হারিকেন সার্চ বাতি, দেশে বিদেশে জনকল্যাণ কাজে ঢাকার নওয়াবদের অর্থদানের বিবরণ, সিগন্যাল বাতি, বিভিন্ন বিদেশী বৈদ্যুতিক বাল্ব, কেরোসিন চালিত পাখা, বিভিন্ন প্রকার কাঁচের লাইট, মোমবাতি ষ্ট্যান্ড, ফানুস রয়েছে।
অবস্থান
বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পাশে আহসান মঞ্জিল অবস্থিত।
সময়সূচী
• গ্রীষ্মকালীন সময়সূচী: (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) - (শনিবার-বুধবার) সকাল ১০.৩০ মি. – বিকাল ৫.৩০ মিনিট। শুক্রবার- বিকেল ৩.০০ মি. – সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিট।
• শীতকালীন সময়সূচী: (অক্টোবর –মার্চ) - (শনিবার-বুধবার) সকাল ৯.৩০ মিনিট – বিকাল ৪.৩০ মিনিট। শুক্রবার – দুপুর ২.৩০ মিনিট – সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিট।
• সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এবং সকল সরকারি ছুটির দিনে জাদুঘর বন্ধ থাকে।
টিকেট ও কাউন্টার
• আহসান মঞ্জিলের পূর্ব পাশে যে ফটকটি উন্মুক্ত তার ডান পাশে যে সৈনিক ব্যারাক ও দারোয়ান এবং গার্ডরুম ছিল তা এখন টিকেট কাউন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
• প্রাপ্ত বয়স্ক জনপ্রতি বাংলাদেশী দর্শক ৫ টাকা
• জনপ্রতি অপ্রাপ্ত বয়স্ক জনপ্রতি বাংলাদেশী শিশু দর্শক (১২ বছরের নিচে) ২ টাকা
• সার্কভুক্ত দেশীয় জনপ্রতি দর্শক ৫ টাকা
• অন্যান্য বিদেশী জনপ্রতি দর্শক ৭৫ টাকা
• প্রতিবন্ধী দর্শকদের জন্য কোন টিকিটের প্রয়োজন হয় না
• পূর্ব থেকে আবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে জাদুঘর দেখতে দেয়া হয়।
• অগ্রীম টিকিটের কোন ব্যবস্থা নেই।
• আহসান মঞ্জিল বন্ধ হওয়ার ৩০ মিনিট আগ পর্যন্ত টিকেট সংগ্রহ করা যায়।
(১১) শিশু জাদুঘরঃ শিশু জাদুঘরটি হচ্ছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর কেন্দ্রীয় চত্বরে। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালে। জাদুঘরটি দোতলা। নিচতলার নাম “বাংলাদেশ যুগে যুগে”। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একেবারে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে পুরো ইতিহাস রয়েছে এখানে। ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মের মাধ্যমে ৭২টি শোকেসে সাজানো আছে আমাদের জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনীতি-অর্থনীতি। তবে ঢোকার মুখেই বাম পাশে একটি শোকেসে পাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চার কিশোর মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস। এরা হলো_কায়কাউস মোহাম্মদ রাজিউল আলম, মতিউর রহমান মলি্লক, মাজহারুল মুনির সবুজ ও শামীমুর রহমান। 'মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শিশু-কিশোর' নামের এ শোকেসে আছে ওদের ব্যবহৃত ছবি, জিনিসপত্র, বই, খাতা, কলম, গ্লাস, প্লেট ও ঘড়ি। কমিকসের বইও আছে। দ্বিতীয় তলার নাম রাখা হয়েছে_'দেখব এবার জগৎটাকে'। ২৪টি দেশের জন্য ২৪টি শোকেস সাজানো আছে, ওই সব দেশের বিভিন্ন খেলনা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের জিনিসপত্তর দিয়ে। এ ছাড়া এই অংশে আছে কিছু বিজ্ঞান প্রজেক্ট ও স্ট্যাম্প।
সময়সূচীঃ রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯.০০ টা থেকে বিকেল ৫.০০ টা পর্যন্ত; সাপ্তাহিক বন্ধ শুক্রবার ও শনিবার এবং সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে। প্রবেশের জন্য কোন টিকেট কাটতে হয় না।
(১২) ঢাকা চিড়িয়াখানার প্রাণী জাদুঘরঃ মিরপুরে অবস্থিত ঢাকা চিড়িয়াখানার ভেতরে রয়েছে প্রাণী জাদুঘর। প্রাণী জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে মৃত ডলফিন থেকে বিভিন্ন প্রাণীর কঙ্কাল, মৃত দেহের মমি প্রভৃতি। ১০ টাকা দিয়ে চিড়িয়াখানায় প্রবেশের পর এর একেবারে শেষপ্রান্তে দক্ষিণে প্রাণী জাদুঘরে প্রবেশের জন্য দর্শকদের বাড়তি দুই টাকার টিকিট কিনতে হয়। তবে সেখানে চরম অবহেলায় সংরক্ষিত মৃত প্রাণীগুলোকে যে কারো মনে হতেই পারে, এটি বুঝি কোনো পশু-পাখির ভাগাড়! জাদুঘরটি মাত্র ১৭৮ বর্গ মিটারের একটি কক্ষে স্বল্প আলোয় কোনো রকমে গাদাগাদি করে রাখা ১১৮টি প্রাণীর মমি (স্টাফিং) এবং ফরমালিন দিয়ে রাখা ১৬০টি প্রাণীর কাচের বাক্সে শুধু নামফলক দিয়েই দায়িত্ব সারা হয়েছে।
নিদর্শনগুলো সম্পর্কে দর্শনার্থীদের অবহিত করার জন্য কোনো গাইড নেই। পুরো জাদুঘরে ছড়িয়ে পড়েছে ফরমালিনের কটু গন্ধ। মমি করে রাখা চিতা বাঘ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান বাঘ, বানর, বেবুন, শিম্পাঞ্জি, শেয়াল, বাঘডাস, ক্যাঙ্গারু, টাপিরসহ বেশ কয়েকটি প্রাণীর লোম ও চামড়া খসে পড়ে এগুলোর ভেতরের তুলো বেরিয়ে পড়েছে। কয়েকটি নিদর্শনের একাংশ মুড়ে দেওয়া হয়েছে বিসদৃশভাবে টেপ দিয়ে। শকুন, বাজপাখি, ময়ূর, লেজঝোলাসহ আরো কয়েকটি পাখির পালক খসে পড়ছে। নিদর্শন রাখার কাচের জারগুলোও লালচে ও ঘোলা হয়ে গেছে। জাদুঘরটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত না হওয়ায় সংরক্ষিত মৃত বন্য পশুগুলোর লোম ও চামড়া খসে পড়ছে। পাখিগুলোর পালকও ঝরে যাচ্ছে।'
পুরো জাদুঘরটিকে সঠিক পরিকল্পনা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনায় ঢেলে সাজানো দরকার। এ জন্য উচ্চপর্যায়ের নীতি-নির্ধারণী মহলের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। তারপরও দেখে আসতে পারেন এই পশু জাদুঘরটি।
(১৩) উদ্ভিদ জাদুঘরঃ আমাদের উদ্ভিদ জাদুঘর ষাটের দশকের শেষে যে বীজটি রোপণ করেছিলেন ড. সালার খান, চার দশক পেরিয়ে আজ তা মহিরুহ। ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামে সংরক্ষিত আছে নানা জাতের উদ্ভিদের প্রায় এক লাখ নমুনা এবং শুকনো বীজ। ১৯৬৪ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক এক সিম্পোজিয়াম। সেখানে ঢাকায় একটি হার্বেরিয়াম স্থাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ। প্রাদেশিক সরকারের কাছেও পেশ করা হয় প্রস্তাব। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে পাঠানো হয় একটি প্রস্তাবনা। সাড়া মেলে ১৯৭০ সালে। মাত্র দুইজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড. সালার খান এবং মোহাম্মদ ইসমাইলের তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় তলায় যাত্রা শুরু করে 'বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইস্ট পাকিস্তান'।
স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় 'বোটানিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ'। ১৯৭৫ সালে 'বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার রিসার্স কাউন্সিল'-র অধীনে নিয়ে ঢাকার মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে স্থাপন করে এটির নাম রাখা হয় 'বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম'। প্রতিষ্ঠানটিকে কাঠামোগত রূপদানের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন প্রখ্যাত ট্যাক্সোনমিস্ট ড. সালার খান।
১৯৯৪ সাল থেকে ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত। হার্বেরিয়ামের কাজ
হার্বেরিয়ামে সংরক্ষণ করা হয় নানা জাতের উদ্ভিদের শুকনো বীজ এবং নমুনা। পাশাপাশি থাকে নমুনাগুলোর নাম, গোত্র, প্রাপ্তিস্থান, প্রাপ্তিকাল, সংগ্রাহকসহ প্রয়োজনীয় নানা তথ্য। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া উদ্ভিদজগতের সব বৈশিষ্ট্য এবং তথ্য বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে সংরক্ষণ এবং গবেষণার সময় সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার।
দেশের সবচেয়ে বড় এই উদ্ভিদ সংগ্রহশালায় রয়েছে লক্ষাধিক হার্বেরিয়াম শিট। সংরক্ষিত আছে এ অঞ্চলের উদ্ভিদের এক বিপুল সম্ভার। এখানে আছে চারটি বিভাগ_টেক্সোনমি, টিস্যু কালচার, সাইটোজেনেটিক্স এবং অ্যানাটমি।
(১৪) ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নগর জাদুঘরঃ ১৯৮৭ সালে ঢাকার ১৩৩ গ্রিন রোডের জাহানারা গার্ডেন ছিল বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নগর জাদুঘরের প্রথম অস্থায়ী কার্যালয়। তবে পুরান ঢাকার পাঁচভাই ঘাট লেনের একটি বাড়িতে প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল জাদুঘরটি। ১৯৯৬ সালের ২০ জুলাই নগর ভবনের ষষ্ঠ তলার একটি সুপরিসর হলঘরে এটা স্থায়ীভাবে স্থান লাভ করে। বর্তমানে এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করে। ঢাকার সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের বেশ কিছু সংগ্রহ রয়েছে এ জাদুঘরে। নানা ঐতিহাসিক স্থাপনার ওপর কার্ড, পোস্টার, পুস্তিকা এবং ঢাকার বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছে জাদুঘরটি। এর মধ্যে রয়েছে- শামসুর রাহমানের 'স্মৃতির শহর', আবদুল কাইউমের 'চকবাজারের কেতাবপঞ্জি', আবদুল করিমের 'ঢাকাই মসলিন', মুনতাসীর মামুনের 'ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামান', প্যাকি গ্যাডেসের 'ঢাকা নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা' ইত্যাদি। রয়েছে মোগল এবং ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন দলিল, ছবি এবং গ্রন্থসহ নানা জিনিস। ঢাকার ১৯৮৯, '৫২, '৬৬, '৬৭ ও ১৯৭১ সালসহ নানা আন্দোলনের আলোকচিত্র এবং পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের কাটিংও রয়েছে। সকল সরকারী কার্যদিবসে জাদুঘরটি উন্মুক্ত থাকে সর্বসাধারণের জন্য।
(১৫) ডাক জাদুঘরঃ ডাক জাদুঘরটির পত্তন হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন ডাক বিভাগের মহাপরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জাদুঘরটিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলেন। জিপিওর ভেতরে ডাক ভবনে ডাক অধিদপ্তরের তৃতীয়তলার পশ্চিম পাশে এ জাদুঘরের অবস্থান। বায়তুল মোকাররম গহনা মার্কেটের দিক দিয়ে ডাক ভবনে ঢুকলেই পাওয়া যাবে এর দেখা। দুটি কক্ষে ২১৬০ বর্গফুট জায়গায় সাজানো হয়েছে জাদুঘর। প্রথমে ছোট্ট একটি কক্ষ ডাকটিকিট দিয়ে সাজানো। এখানকার ডাকটিকিটগুলো ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নভুক্ত ১৯১টি দেশ থেকে সংগৃহীত। পাশেই বিশাল একটি কক্ষজুড়ে আছে মূল পোস্টাল মিউজিয়াম। কক্ষে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে ডাক বিভাগের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রচরিত নানা রকম অনুষঙ্গ। কাচের বাক্সে সাজানো আছে রানার বা পোস্টম্যানের একটি অবয়ব। কাঁধে ব্যাগ, হাতে লণ্ঠন আর ঘুঙুরযুক্ত বর্শা হাতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। পাশেই লেখা সুকান্তের সেই কবিতা 'রানার'। পাশে সাজানো আছে একটি পোস্ট অফিসের মডেল। অফিসের কোন স্থানে কিভাবে কাজ হয় তা দেখানো হয়েছে কয়েকটি মডেলে।
ডাক বিভাগের সঙ্গে জড়িত দেশ-বিদেশের অনেক ব্যক্তির ছবি টাঙানো আছে দেয়ালে। মধ্যখানে বিশাল জায়গাজুড়ে আছে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত সিলমোহর ও প্রকাশনা। এক পাশে সাজানো আছে নানা আকৃতির ডাকবাক্স। সেসব বাক্সের গঠনও নানা রকমের। রানি ভিক্টোরিয়ার সময়কার ডাকবাক্সের মাথায় আছে রাজমুকুটের প্রতিরূপ।
১৮৯০ সালের ৯ মণ ওজনের একটি ডাকবাক্স সংরক্ষিত আছে এখানে। আরো আছে নানা দেশের নানা গড়নের ডাকবাক্স। বার্মিংহামের তৈরি সাত মণ পণ্য ওজন করা যায় এমন একটি স্কেল আছে এই জাদুঘরে। নানা আকৃতির পার্সেল ওজন দেওয়ার স্কেল আছে ১০টিরও বেশি। আছে ওজন মাপার পুরনো বাটখারা। জ্বরের ওষুধ কুইনাইন বিক্রি হতো ডাক বিভাগের মাধ্যমে। তারই একটি বিজ্ঞাপন সংরক্ষিত আছে এখানে। বিশাল গ্যালারিজুড়ে সাজানো আছে রানার বা পোস্টম্যানদের ব্যবহৃত ব্যাগ, মানিকট ব্যাগ, চামড়ার ব্যাগ, ব্যাগ কাটার ছুরি, তালা, নানা আকৃতির তালার চাবিসহ অনেক কিছুই। আরো আছে পাঞ্চিং করার পুরনো মেশিন ও পোস্টম্যানদের ব্যবহৃত ঘড়ি।
পূর্ব গ্যালারির নিচে সাজানো আছে সরকার প্রধান ও বিশেষ ব্যক্তিদের উদ্বোধন করা খামসহ ডাকটিকিট। প্রতিটি খামেই আছে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধানের স্বাক্ষর। দেয়ালে সাজানো আছে ১৯৭০ সালের রানারদের ব্যবহৃত বর্শার ফলা লাগানো লাঠি। এই ঘুঙুর লাগানো বর্শা নিয়ে হাঁটলেই ঝুমঝুম শব্দ হতো। যে শব্দ শুনেই লোকে বুঝে ফেলতো, রানার আসছে খবরের বোঝা কাঁধে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রানারদের সঙ্গে নিরাপত্তার জন্য তলোয়ারও থাকতো। তেমন কয়েকটি তলোয়ারও সাজানো আছে এখানে। আরো আছে পোস্টম্যানের ব্যবহৃত বিউগল ও বন্দুক। ব্রিটিশ আমলের একটি বিচিত্র হারিকেনও দেখতে পাবেন। পোস্টম্যানের মাথার ধাতব টুপি, বাতি, চামড়ার ব্যাগসহ নানা রকম ব্যাজ_সবই আছে সযত্নে। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ডাক বিভাগের সব তথ্যই আছে এখানে। জাদুঘরে পাওয়া যাবে বিশ্বের বিভিন্ন সময়কার ডাক বিভাগের নানা তথ্য। চালনায় জাহাজের ভেতরেই ছিল পোস্ট অফিস। জাহাজের সেই মোবাইল পোস্ট অফিসের একটি মডেল রাখা হয়েছে পোস্টাল মিউজিয়ামে। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিনই সকাল ৯টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত খোলা থাকে ডাক জাদুঘরটি। জাদুঘরের ঢুকতে কোনো প্রবেশ মূল্য লাগবে না।
(১৬) রাজারবাগের জাদুঘরঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রথম যেখানে আক্রমণ চালিয়েছিলো ঢাকায় সেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই রাজারবাগ থেকেই বাঙ্গালী পুলিশ সদস্যরা প্রথম প্রতিরোধ রচনা করেছিলেন। প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলো সারাদেশে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একযোগে আক্রমন চালিয়েছিলো ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিলখানা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে রাজারবাগেই তারা প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় বাঙ্গালী পুলিশ সদস্যদের দ্বারা। একই সংগে পুলিশ সদস্যরা বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে ঢাকা আক্রান্ত হওয়ার বার্তা সারাদেশের থানাগুলোতে প্রেরণ করলে প্রতিরোধ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আক্রান্ত হওয়ার পরপরই ওয়ারলেস বা বেতারযন্ত্রের অপারেটর মো: শাহজাহান মিয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ উদ্যেগে বার্তাটি প্রেরণ করেন।
ন'মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে পুলিশ সদস্যদের ওই গৌরবোজ্জ্বল ত্যাগকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। সোমবার থেকেই এ জাদুঘরটি জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এই জাদুঘরে সেই বেতারযন্ত্রটি ছাড়াও স্থান পেয়েছে একটি পাগলা ঘন্টা, যেটি বাজিয়ে সেই রাতে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করছিলেন কনস্টেবল আব্দুল আলি। এছাড়া আরও রয়েছে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা ও ইউনিফর্ম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেতারে ভাষণ দিয়ে পুলিশ সদস্যদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই ভাষণের কপিও রাখা হয়েছে জাদুঘরে। এছাড়া জাদুঘরের দেয়াল জুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বিভিন্ন ধরনের আলোকচিত্র এবং পোস্টার। সকল সরকারী কার্যদিবসে জাদুঘরটি উন্মুক্ত থাকে সর্বসাধারণের জন্য।
(১৭) টাকা জাদুঘরঃ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে ঢাকার মিরপুর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে টাকা জাদুঘর বা মুদ্রা জাদুঘর। প্রাচীন বাংলায় যখন থেকে মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হয়েছিলো তখন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত কালের পরিক্রমায় যত রকম ধাতব এবং কাগুজে মুদ্রা প্রচলিত হয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনের জন্য ২০১৩ সালে উদ্বোধন করা হয় এই জাদুঘরের। মুদ্রার পাশাপাশি প্রাচীনকাল হতে মুদ্রা সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত কাঠের বাক্স ও লোহার সিন্দুকও রয়েছে এই জাদুঘরের সংগ্রহশালায়। পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে নিজস্ব সীমিত পরিসরে একটি কারেন্সি মিউজিয়াম ছিলো, যার পরিবর্ধিত এবং সকলের জন্য উন্মুক্ত রূপ এই কারেন্সি মিউজিয়াম।
এই টাকার জাদুঘরে আপনি দেখতে পাবেন বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত পাঞ্চ মার্কড (রৌপ্য মুদ্রা) যার ব্যাপ্তি খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম-৪র্থ শতক থেকে খ্রিষ্টাব্দ ২য় শতক পর্যন্ত। আরও দেখতে পাবেন কুষাণ মুদ্রা, হরিকেল মুদ্রা, দিল্লী ও বাংলার সুলতানদের মুদ্রা, মোগল ও ব্রিটিশ শাসকদের মুদ্রাসহ আধুনিক মুদ্রার সংগ্রহশালা। মুদ্রার পাশাপাশি ১৯ শতক পর্যন্ত বাংলায় ক্ষুদ্র লেনদেনে মুদ্রা হিসেবে কড়ি ব্যবহৃত হত, সেগুলোও এখানে দেখতে পাবেন। এখানে রয়েছে কুষাণ সম্রাটগণের প্রদত্ত শক পার্থিয়ান ও তাম্রমুদ্রার কিছু নমুনা রয়েছে যা খ্রিষ্টাব্দ ১ম ও ২য় শতকে ব্যবহার করা হত। হরিকেল মুদ্রা মূলত ৭ম ও ৮ম খ্রিষ্টাব্দের দিকে বর্তমান সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লার ময়নামতি, চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ব্যবহার হত। ময়নামতির প্রত্নস্থল থেকে বিপুল হরিকেল মুদ্রা পাওয়া যায়।
মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে তথা সুলতানি শাসনামলে (১৪শ ও ১৫শ শতকে) ২৬ জন শাসক বাংলার বিভিন্ন টাকশাল থেকে মুদ্রা জারি করেন। মুদ্রার তথ্যের উপর ভিত্তি করে এখন পর্যন্ত ৪০টি টাকশালের নাম পাওয়া গেছে। গজনীর সুলতান মাহমুদ সর্বপ্রথম মুদ্রাকে 'টঙ্কা' বা 'টাকা' হিসেবে পরিচিতি প্রদান করেন। দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশ তার স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার নাম দিয়েছিলেন 'তানকাহ' বা 'টাকা'। এছাড়াও 'টাকা জাদুঘর'-এ রয়েছে মোঘল সময়কালের 'কোচ' ও 'অহম' বা 'আসাম' মুদ্রা। 'টাকা জাদুঘর'-এর প্রদর্শনীতে বিশেষ ভাবে স্থান পেয়েছে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলক শাহ, মোগল সম্রাট শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, ফররুখশিয়ার ও ব্রিটিশ ভারতীয় স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র মুদ্রা এবং কাগজের নোট। এছাড়াও আছে ব্রিটিশ পরবর্তী পাকিস্তান আমল, স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা ও কাগজের নোটের ধারাবাহিক ইতিহাস।
জাদুঘরে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২০টি দেশের কাগজের নোট, পলিমার, হাইব্রিড নোট ও ধাতব মুদ্রা রয়েছে। জাপান ও জার্মান টাকশালের মুদ্রা তৈরির মাস্টার জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ। বিভিন্ন দেশ তথা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, সাবেক চেকোস্লোভাকিয়া, ইতালি, আফগানিস্তান, চীন, ল্যাটিন আমেরিকা, ভিয়েতনাম, লিথুনিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া এবং কমিউনিস্ট আমলের পোলিশ ব্যাংক নোট, চেক ও বন্ড। বর্তমান সময়ের যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, জামার্নি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান এর মুদ্রা।
এছাড়া ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, দিবস এবং কালজয়ী ব্যক্তিদের স্মরণে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ১২টি স্মারক মুদ্রা ও ৪টি স্মারক নোট প্রকাশ করেছে। এগুলোর মধ্যে ১টি স্বর্ণের, একটি নিকেলের ও বাকিগুলো রৌপ্য মুদ্রা। এ সকল মুদ্রা ও নোটগুলো দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করবে। শুধুমাত্র মুদ্রা বা নোট নয় আছে মুদ্রা তৈরির ডাইস, মুদ্রায় নির্মিত বাংলার ঐতিহ্যবাহী অলঙ্কার, বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা দ্রব্যাদি, শস্য সংরক্ষণে রাখা মাটির মটকি প্রভৃতি।
সময়সূচীঃ শনিবার থেকে বুধবার সকাল ১১.০০ টা থেকে বিকেল ৫.০০ টা পর্যন্ত; সাপ্তাহিক বন্ধ বৃহষ্পতিবার। শুক্রবার খোলা থাকে বিকেল ০৪:০০ টা থেকে সন্ধ্যা ০৭:০০ টা পর্যন্ত। এখানে প্রবেশের জন্য কোন প্রবেশ ফি লাগে না।
(১৮) বাঙালি সমগ্র জাদুঘরঃ ২০০৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষা আন্দোলনে বায়ান্নতম বছরে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারাকে সমৃদ্ধ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যথাযথভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীর্তিমান বাঙালির অবদান, তাদের সৃষ্টি ও কর্ম স্থায়ী সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের লক্ষ্যে ২৩৫/২, এলিফ্যান্ট রোডস্থ খায়ের ম্যানসন ভবনে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠায় এই জাদুঘর তার যাত্রা শুরু করে। ঢাকায় এলিফ্যান্ট রোড বাটা সিগন্যাল মোড় এই জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা। বাঙালি সমগ্র জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক তারিক রহমান সৌরভ। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিসেবীর উপদেষ্টা হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি পর্যায় থেকেই জড়িত।
বাঙালি সমগ্র জাদুঘরে যা রয়েছে- সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়াত ষাট বিশিষ্ট বাঙালির প্রোর্ট্রটে বা প্রতিকৃতি রয়েছে এ জাদুঘরে। মোট ৪টি বিভাগে পোর্ট্রটেগুলোকে ভাগ করা হয়েছে তা হলো- (১) ভাষা-শিক্ষা-সাহিত্য (২) সংগীত-নাটক-চলচ্চিত্র-ক্রীড়া (৩) সমাজ-রাজনীতি-সর্বনীতি (৪) বিজ্ঞান-স্থাপত্য-শিল্পকলা। মাত্র বিশটি মূল স্মারক নিয়ে ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করা এই জাদুঘরের স্মারক সংখ্যা এখন পঞ্চান্নটি। প্রতিদিন আসা দর্শনার্থীরা অবাক হয়ে দেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কবিতার মূল কপি, কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ধূমকেতু (১৯২২) পত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশিত, বেগম রোকেয়ার হাতের লেখা চিঠি (১৯২৬ সালের), সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর গানের স্বরলিপি শিল্পী আবদুল লতিফের ব্যবহৃত দোতারা, চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের মুভি ক্যামেরা, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রচনার পাণ্ডুলিপি, শিল্পী কাজী আবুল কাশেমের আঁকা তৈলচিত্র, পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা স্কেচ। মোট ৪টি বিভাগের আওতায় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়াত ও জীবিত বিশিষ্ট বাঙালির জীবন ও কর্ম সম্পর্কে যথাযথ ধারণা দেয়ার লক্ষ্যে ‘প্রতিকৃতি’ নামে শতাধিক জীবনী সংবলিত হয়েছে।
২০০৪ সালের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট বাঙালির জীবন ও কর্মভিত্তিক সাক্ষাৎকারমূলক তথ্যচিত্র। সচল প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছে। এ পর্যায়ে বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী, প্রবীণ সাংবাদিক ওবায়েদ উল হক, প্রথম বাঙালি মুসলমান চিত্রকর কাজী আবুল কাশেম, কলিস শরাফী, ফিরোজা বেগম, কবি আবুল হোসেন, কবি শামসুর রহমান, নাট্যকার সাঈদ আহমেদ, ‘বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগসের দর্শক বিনামূল্যে এসব জীবনীচিত্র দেখতে পারেন। প্রায় দুই হাজার স্থানীয় পুস্তক নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি গ্রন্থাগার, যা এই জাদুঘরে আসা মনস্ক দর্শকদের বিভিন্ন অনুসন্ধিৎসার খোরাক হয়।
আরও কিছু জাদুঘরঃ
বাংলা একাডেমি
বা লোক ঐতিহ্য জাদুঘর
জাতীয় সাহিত্য
ও লেখক জাদুঘর
বিজয় কেতন মুক্তিযুদ্ধ
জাদুঘর
শহীদ জননী জাহানারা
ইমাম স্মৃতি জাদুঘর
বঙ্গবন্ধু ও
চার নেতার কারা স্মৃতি জাদুঘর
আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা ইনিস্টিটিউট ভাষা জাদুঘর
বিমান জাদুঘর