টানা দশ সপ্তাহ পর গত সপ্তাহ দুয়েক আগে ছুটির দিন প্রকৃতই সারাদিন বাসায় থেকে ছুটি উপভোগ করি। কিন্তু পাগল মন কেন জানি ঘরে টিকতে চায় না। তাইতো গত সপ্তাহে পানাম নগর ঘুরে এসে মনটা আকুপাকু করছিল। বুধবার ডিসিশন নিলাম এইবার যাব গাজীপুরের জমিদার বাড়ীগুলো দর্শনে। খুঁজে পেতে দেখা গেল বিখ্যাত কয়েকটি জমিদারবাড়ী রয়েছে গাজীপুরে। অফিসে বসে বসেই কয়েকবার গুগল ম্যাপে রুট প্ল্যান করে শেষে ঠিক করলাম ভাওয়াল জমিদার বাড়ী দিয়ে শুরু করে পথে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান হয়ে যাব লেখক হুমায়ূনের জমিদার বাড়ী দেখতে।
পাঠক অবাক হবেন না, হুমায়ূন আহমেদের “নুহাশ পল্লী” ঘুরে আসলে আপনিও মানতে বাধ্য এটা আধুনিক কালের বাংলার জমিদার বাড়ী বলা যায়। গত সপ্তাহের পানাম নগর গিয়েছিলাম সম্পূর্ণ একাকী। একা একা ঘুরতে আলাদা মজা থাকলেও আমি দলবদ্ধ হয়ে ঘুরতেই পছন্দ করি। বন্ধু মনা এবার আমার সঙ্গী হওয়ার কথা থাকলেও ব্যাস্ততার কারনে তাকে এবার পেলাম না। শেষে বৃহস্পতিবার দুপুরে টিনেজ পার করা দুই খালাতো ভাইকে এবার সঙ্গী করলাম। এদের একজন আবার মহা হুমায়ূন ভক্ত। আগের দিনই পুরো ভ্রমণের খসড়া করে শিডিউল আকারে প্রিন্ট করে নিলাম। পরের দিন সকাল সাতটায় যাত্রা হবে শুরু।
দুই খালাতো ভাইকে নিয়ে সকাল সাতটায় যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমেই এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে নাশতা সেরে নিয়ে শাহবাগ হতে গাজীপুর শিববাড়ীগামী ঢাকা পরিবহণের গাড়ীতে করে রওনা দিলাম। ঢাকার যে কোন প্রান্ত হতে গাজীপুরগামী বাসে করে যে কেউ চলে আসেতে পারেন গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তা। সেখান থেকে বামে চলে গেছে শিববাড়ীর রাস্তা। শিববাড়ী বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যায় ঢাকা পরিবহন, বিআরটিসির গাড়ীগুলো। ভাড়া ৪০-৬০ টাকার মধ্যে। আমরা নামলাম শিববাড়ী বাসস্ট্যান্ডে, সেখান থেকে চার্জিত ব্যাটারিচালিত রিকশা করে ২০ টাকার ভাড়ায় গেলাম ভাওয়াল রাজবাড়ী যা এখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভাওয়ালের রাজবাড়ী ছিল ভাওয়াল এস্টেটের মূল পরিচালনা কেন্দ্র। ভাওয়াল এস্টেট পরিধি এবং আয়ের দিক থেকে পূর্ব বাংলায় নওয়াব এস্টেটের পরেই ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারি। ভাওয়াল জমিদার বংশের পূর্বপুরুষগণ মুন্সিগঞ্জের অন্তর্গত বজ্রযোগিনী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন বলে জানা যায়। এই বংশের জনৈক বলরাম সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভাওয়াল পরগনার জমিদার দৌলত গাজীর দীউয়ান হিসেবে কাজ করতেন। বলরাম এবং তার পুত্র শ্রীকৃষ্ণ তৎকালীন বাংলার দীউয়ান মুর্শিদকুলী খানের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন এবং কৌশলে গাজীদের বঞ্চিত করে জমিদারি হস্তগত করেন। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে মুর্শিদকুলী খান বহু মুসলমান জমিদারকে বিতাড়িত করে তদ্স্থলে হিন্দু জমিদার নিযুক্ত করেন।
ভাওয়ালের গাজীগণ মুর্শিদকুলী খানের এই নীতির কারণে জমিদারি স্বত্ব হারান। ১৭০৪ সালে শ্রীকৃষ্ণকে ভাওয়ালের জমিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকে এই পরিবারটি ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে এই জমিদারির অধিকারী ছিলেন। ১৮৫১ সালে পরিবারটি নীলকর জেমস ওয়াইজ এর জমিদারি ক্রয় করে। এই ক্রয়ের মাধ্যমে পরিবারটি সম্পূর্ণ ভাওয়াল পরগনার মালিক হয়ে যায়। ১৮৭৮ সালে এই পরিবারের জমিদার কালীনারায়ণ রায়চৌধুরী ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে বংশানুক্রমিক ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন। কালীনারায়ণের পুত্র রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী এই জমিদারির আরও বিস্তৃতি ঘটান। এই সময়ই ভাওয়াল জমিদারি ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে এবং পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারিতে পরিবর্তিত হয়।
ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারি ব্যবস্থাপনা ছিল সবিশেষ দক্ষতাপূর্ণ। দেশের বেশির ভাগ জমিদার বিভিন্ন শহরে অনুপস্থিত জমিদার হিসেবে বাস করলেও ভাওয়ালের রাজা কিন্তু জমিদারির একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত জয়দেবপুর গ্রামে বাস করতেন। রাজা নিজেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। সনাতনীভাবে বেশির ভাগ বড় জমিদার তাদের জমিদারি ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের নায়েব গোমস্তাদের ওপর নির্ভর করতেন। কিন্তু ভাওয়াল রাজা এই ব্যবস্থাপনা স্বহস্তেই করতেন এবং প্রতিদিন ও নির্ধারিত সময়ে কাচারিতে বসতেন।
সম্পূর্ণ জমিদারিটি কয়েকটি সার্কেলে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি সার্কেল একজন মফস্বল নায়েবের ওপর ন্যস্ত ছিল, যাকে একদল তহসিলদার, মুহুরি, জমাদার, পিয়ন, ঝাড়ূদার এবং কুলি সাহায্য করত। এছাড়াও তার অধীনে থাকত একদল লাঠিয়াল, যাদেরকে প্রয়োজনে অবাধ্য রায়তদেরকে অনুগত করার কাজে ব্যবহার করা হতো। প্রতিটি গ্রামে একজন করে মণ্ডল নামে জমিদারির কর্মকর্তা থাকত, যার মাধ্যমে সেই গ্রামের খাজনা আদায় করা হতো। জমির খাজনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে প্রতিটি গ্রাম জরিপ করা হতো। বাংলার অন্যান্য জমিদারের মতো ভাওয়াল রাজা কিন্তু সাধারণভাবে কোন মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি করেন নি। জমিদারির প্রধান কাচারি জয়দেবপুরেই অবস্থিত ছিল। এই কাচারিতে রাজার জন্য একটি গদি বা বিশেষ আসন ছিল। জমিদারির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দীউয়ান বলা হতো, যার অধীনে ছিল একজন উপ-দীউয়ান, কয়েকজন নায়েব ও গোমস্তা। জমিদারির বিভিন্ন এলাকার জন্য দীউয়ান খানায় আলাদা আলাদা ডেস্ক ছিল এবং প্রতিটি ডেস্কের জন্য বিভিন্ন ধরনের বেশ কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল।
ভাওয়াল এস্টেটের সর্বশেষ ক্ষমতাবান জমিদার ছিলেন রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী। কালীপ্রসন্ন ঘোষ ছিলেন তাঁর দীউয়ান। উল্লেখ্য যে, কালীপ্রসন্ন ঘোষ ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান লেখক ছিলেন। রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর ছিল তিন পুত্রসন্তান। তাঁরা হলেন রণেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী, রমেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী এবং রবীন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী। ১৯০১ সালে রাজেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয়। এই সময় তাঁর তিনপুত্র সন্তানই ছিলেন নাবালক। সে কারণে জমিদারিটি একবার ১৯০১ সালে এবং আর একবার ১৯০৪ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে চলে যায়।
রাজেন্দ্রনারায়ণের তিন পুত্র সন্তানকেই একজন ইউরোপীয় গৃহ-শিক্ষক লেখাপড়া শেখাতেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, তিন পুত্রই ছিলেন অজ্ঞ ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ, লেখাপড়া ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত অমনোযোগী। একবার দ্বিতীয় পুত্র রমেন্দ্রনারায়ণ চিকিৎসার জন্য দার্জিলিং গমন করেন। সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয় এবং যথারীতি দাহ করা হয় বলেও দাবী করা হয়। অপর দুই পুত্রও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন এবং পরিবারটি পুত্র সন্তানবিহীন অবস্থায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় পুত্র সন্তানটি নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি বহুদিন যাবৎ সন্ন্যাসী হিসেবে জীবন যাপন করেন। পরিশেষে ১৯২০ সালের শেষের দিকে তিনি নাটকীয়ভাবে দারুণ সাড়া জাগিয়ে প্রায় ১২ বছর পর ঢাকায় এসে উপস্থিত হন এবং তার জমিদারি দাবি করেন। এভাবেই ১৯৩৫ সালে শুরু হয় বিখ্যাত ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা, যা সমগ্র বাংলায়, এমনকি বাংলার বাইরেও প্রায় এক যুগ ধরে খবরের কাগজে সংবাদ এবং নানা ধরনের গল্প গুজবের প্রধান উপাদান হয়ে থাকে। এমনকি ঘটনাটি সারা ভারতবর্ষে বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য, নাটক এবং সিনেমারও বিষয়বস্তু হয়। ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার পরে জমিদারির উত্তরাধিকারের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে এবং ফলে এর ব্যবস্থাপনা ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনেই থেকে যায়। যেহেতু উত্তরাধিকারী নিয়ে বহু জটিলতা ছিল এবং জমিদারি সংক্রান্ত বহু মামলাও অমীমাংসিত ছিল, সে কারণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণার পরেও এর বিষয়-সম্পত্তি বা দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে বণ্টন করা সম্ভব হয় নি। ফলে পাকিস্তান আমলেও জমিদারিটি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনেই থাকে। বর্তমানে ভাওয়াল এস্টেটের কর্মকাণ্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি সংস্কার বোর্ড পরিচালনা করে।
গাজীপুর জেলা শহরের প্রাণকেন্দ কালের সাক্ষী দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়ী। সাধারণ কোন রাজবাড়ী বলতে আমরা যা বুঝি এটি কিন্তু তা নয় । আসলে বিশাল এক রাজপ্রাসাদ এটি। আয়তন এবং কক্ষের হিসাবে এত বড় বিশাল রাজপ্রাসাদ বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। দ্বিতল এ রাজপ্রাসাদটিতে সর্বমোট কক্ষ রয়েছে ৩৬৫টি। প্রায় ৫ একর জায়গার উপর রাজপ্রাসাদটি নির্মিত হয়েছে। এটির আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এর পশ্চিম পার্শ্বেই রয়েছে বিশাল একটি দীঘি এবং সামনে রয়েছে বিশাল সমতল একটি মাঠ। এতবড় মাঠও সমগ্র বাংলাদেশে আর নেই। রাজবাড়িটির পুরো এলাকাই সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এর মূল প্রবেশ দ্বার দিয়ে ঢুকে একেবারে পিছনে যেতে হলে হাঁটতে হবে অনেকটা পথ, পেরুতে হবে অনেক অলিন্দ আর বারান্দা। বিশাল এ রাজপ্রাসাদটির বিশালত্ব দেখে যে কেউ অভিভূত হবেন এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
অনেকেই রাজবাড়ীতে ঢুকে গোলক ধাঁধায় হারিয়ে যাবেন - এর অলিন্দ গলি উপগলি দিয়ে একবার হেঁটে গিয়ে পুনরায় সেগুলো খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়বে। রাজবাড়ীর প্রতিটি স্থানে প্রতিটি কক্ষে যেতে হলে দীর্ঘ সময় নিয়ে ঢুকতে হবে এতে। কিছুটা সময় ভাওয়ালের রাজবাড়ীতে কাটিয়ে রওনা দিলাম ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশ্যে।
ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ীর অভ্যন্তর
ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ীর অভ্যন্তর
ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ীর অভ্যন্তরস্থ ফুলের বাগান
ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ী এখন জেলা প্রশাসনের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে
ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ী এখন জেলা প্রশাসনের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে
ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ী হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখছেন বিশিষ্ট দুই পর্যটক