পরের দিন সকাল ছয়টায় ঘর হতে বের হতে হবে জেনেও রাতে ঘুমাতে যেতে অনেক দেরী করেছিলাম। তাই যখন এলার্ম ঘড়ির মিষ্টি সুর একটু একটু করে তন্দ্রা হটিয়ে চেতনা ফেরত দিচ্ছিল, তখন শরীর চাচ্ছিল আরেকটু নিদ্রার কোলে খেলা করতে। কিন্তু বন্ধু মনার ক্ষ্যাপাটে রাগী মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সব ঘুম এক দৌড়ে পালালো। সকাল সাড়ে ছয়টায় আমার বাসস্ট্যান্ডে থাকার কথা, এখন কয়টা বাজে? ভাবতেই লাফ দিয়ে উঠে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি ছয়টা বেজে দশ মিনিট!!!
দ্রুত রেডি হয়ে বাইরে বেড়িয়ে কোন রিকশা পেলাম না, আমার বাসা হতে বাস স্ট্যান্ড মিনিট বিশেকের হাটা পথ। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, এর মাঝে রিকশা খুজতে খুজতে জামা ভিজতে লাগলো। অবশেষে একটা রিকশা পেতে চড়ে বসলাম, আধভেজা হয়ে রওনা দিলাম বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে ঘড়িতে দেখি প্রায় পৌনে সাতটা বাজে, বৃষ্টির জোর বেড়েছে। রাস্তার পাশের এক দোকানের ছাউনিতে দেখি মনা আর টুটু ভাই দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই মনা মিয়ার ঝাড়ি শুরু হয়ে গেল, প্রতিটা ট্যুরে বের হলে সে সারাক্ষণ সবাইকে ঝাড়াঝাড়ি না করে থাকতে পারে না। তার ঝাড়ি থামতে জিজ্ঞাসা করলাম গাড়ীতে না বসে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সে জানালো মাইক্রোবাস এখনও এসে পৌছায় নাই।
বুঝেন অবস্থা, গাড়ির খবর নাই; আর আমাকে ঝাড়ছে দেরী করলাম কেন? নিজে ভিজেছে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে, এই ঝাল আমার উপর মিটানোর ব্যার্থ প্রয়াস। সাতটার দিকে গাড়ী নিয়ে ড্রাইভার হাজির। আমরা মালিবাগ হতে তিনজনকে, ফার্মগেট হতে আরও চারজন আর উত্তরার কাছ হতে আরও চারজনকে তুলে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে চৌদ্দজন নিয়ে যাত্রা করলাম ময়মনসিংহ’র উদ্দেশ্যে। সাথে আরেকটি প্রাইভেট কারে করে আরও চারজন।
আমরা মোট আঠারো জনের দল ভ্রমণ বাংলাদেশ'র আয়োজনে গত এপ্রিল মাসে দুই দিনের জন্য বেড়িয়ে পড়েছিলাম ময়মনসিংহ-শেরপুর’এর উদ্দেশ্যে, লক্ষ্যস্থল গজনী, মধুটিলা, লাউচাপড়া ঘুরে বেড়ানো।
সকাল থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি ঝরছিল বাইরের দিকে, আর আমরা চৌদ্দজন ভ্রমণচারী একটি ছোট্ট মাইক্রবাসের কাঁচে ঘেরা বক্সে করে চলতে লাগলাম ময়মনসিংহ’র দিকে। টঙ্গি পেরুনোর সময় ঘণ্টা দেড়েক আটকে রইলাম অনাকাঙ্ক্ষিত জ্যামে।
তখনো সকালের নাশতা করা হয় নাই কারো, সাথে করে আনা পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘বাকরখানি’ রুটি চিবুতে শুরু করলাম গাড়ীতে বসে বসে। সকাল নয়টার দিকে আমরা যাত্রা বিরতি করলাম রাস্তার ধারের এক রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা সেরে
নিতে। রাস্তায় শুধু গাড়ী আর গাড়ী, জ্যামে বসে থেকে থেকে বোর হওয়া ছাড়া আর কি করার। কেউ কেউ হেডফোন কানে গুঁজে দিয়ে গান শুনতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল, কেউ জুড়ে দিল রাজনৈতিক আলোচনা।
দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা জার্নি শেষে আমরা পৌঁছলাম ময়মনসিংহ, এখানে নজরুল স্মৃতি সংগ্রহশালা দেখা, কিছুটা যাত্রা বিরতি সাথে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নেওয়া।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর স্মৃতি বলয়ে ঘেরা ত্রিশাল এখন নজরুল পল্লী হিসাবে খ্যাত। ত্রিশালে জাতীয় কবির জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে।
ত্রিশালের লোক কাজী রফিজ দারোগা। ১৯১৪ সালের দিকে তিনি যখন ভারতের আসানসোলে যান, দেখা পান কিশোর নজরুলের। রুটির দোকানে কাজ করার পাশাপাশি নজরুলের কাব্য এবং গীতি প্রতিভা দেখে অভিভূত হন রফিজ দারোগা। নজরুলকে প্রস্তাব দেন তার সাথে ত্রিশালে চলে আসার, নজরুল রাজী হয়ে যান। ফলে ১৯১৪ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের মাটিতে পা পরে জাতীয় কবির।
দারোগা রফিজের নিজ গ্রাম ত্রিশালে নিয়ে এসে তিনি কবি নজরুলকে ভর্তি করে দেন ত্রিশাল উপজেলা সদরের দরিরামপুর একাডেমি স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে। ত্রিশাল থেকে বর্ষায় স্কুলে যাতায়াতে অসুবিধা হওয়ার দরুন কবি কাজী নজরুল ইসলাম জায়গীর ছিলেন ত্রিশাল ত্রিশাল উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে নামাপাড়া গ্রামের বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িতে। ময়মনসিংহে বছরখানেকের বেশী স্থায়ী ছিলনা জাতীয় কবির সেই যাত্রায় বাংলাদেশে বসবাস। পরের বছরই কবি ফিরে যান আসানসোল।
কবি নজরুলের সেই বাল্য স্মৃতিকে ধরে রাখতে এ গ্রামেরই বটতলা নামক স্থানে স্থানীয় জনগণের দান করা জমিসহ ২৫ একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য, সঙ্গীত, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল এ চারটি বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করে। পরে পাঁচটি অনুষদের আওতায় ব্যবসায় প্রশাসন, সামাজিক বিজ্ঞানসহ বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকসাহিত্য, লোক সংস্কৃতির উন্নয়ন ও গবেষণারও উদ্যোগ নেয়া হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি বিভাগে সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করার সুযোগ পাচ্ছে।