কাজীর শিমলা, লাউচাপড়া, গজনী আর মধুটিলা - এক ঢিলে চার পাখী (লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্র পর্ব)

লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্র

গল্পের ছবিসকল

  • লাউচাপড়া
  • লাউচাপড়া
  • লাউচাপড়া
  • লাউচাপড়া

কাজীর শিমলাস্থ নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রে ঘণ্টা খানেক কাটিয়ে আমরা ময়মনসিংহ-শেরপুর রোড ধরে এগিয়ে গিয়ে লাঞ্চ সারলাম। এরপর গাড়ী ছুটে চললো শেরপুরের দিকে, বিকেল ছয়টা নাগাদ পৌঁছলাম শেরপুর! মাত্র সোয়া দুইশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ঢাকা থেকে শেরপুর, দশ ঘণ্টা সময় লাগল! ধন্য ধন্য, বলি তারে...... 
সন্ধ্যা নাগাদ শেরপুরের “হোটেল সম্পদ প্লাজা (আবাসিক)” এ উঠলাম আমাদের ১৯ জনের (মাইক্রবাসের ড্রাইভারসহ) দল। মজার ব্যাপার হল মন্দা ব্যাবসা’র কারণে হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সিঙ্গেল রুম নিতে বাধ্য করল, ফলে ১৯ জনের জন্য ১৮টি রুম নিতে হল! যাই হোক সবাই ফ্রেশ হয়ে নিচে রিসিপশনে একে একে জড়ো হলাম, সিদ্ধান্ত হল চা-নাশতা খেয়ে শহরটা ঘুরতে বের হব। হোটেলের ম্যানেজার জানালেন যে শহরে বাণিজ্য মেলা চলছে, আমরা সেখানে যেতে পারি। 
নাশতা সেরে শহরে ঘুরতে ঘুরতে আমরা হাজির হলাম মেলা প্রাঙ্গনে। ছেলেরা মাঠে বসে পড়লাম আড্ডা দিতে, মেয়েরা স্টলে স্টলে ঘুরতে লাগল কিছু কেনা যায় কি না এই আশায়। হায়রে মেয়ে সকল! রাত তখন মাত্র সাতটা। স্থানীয় কিছু মানুষ জানালো জেলা স্টেডিয়ামে বাণিজ্য মেলা চলছে। সবাই চা খেয়ে রওনা দিলাম বাণিজ্যমেলা অভিমুখে। 
তো বাণিজ্যমেলা’র মাঠে বসে কয়েকজন গল্প করছিলাম, আর বাকীরা ইতস্তত ঘোরাফেরা করছিল, ঢুঁ মারছিল বিভিন্ন স্টলে। তো এক বড় ভাই প্রস্তাব করলেন, সবাই মিলে নাইট শো’তে সিনেমা দেখি। কারণ, আমরা যে হোটেলে উঠেছিলাম ঠিক তার বিপরীতে ছিল একটি সিনেমা হল। এই প্রস্তাব কয়েকজন ছাড়া সবাই লুফে নিলো। কয়েকজন আলোচনা শুরু করে দিল শেষ কবে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছে। যাই হোক সবাই বেশ এক্সাইটেড মনে হল। 
আমাদের মধ্যে কনিষ্ঠ একজনকে দায়িত্ব দেয়া হল সিনেমা হলে গিয়ে ওখানকার পরিবেশ, সিনেমা ভালো না মন্দ, হল কেমন এসব খবর নিয়ে আসতে। আমরা গেলাম রাতের খাবার খাওয়ার জন্য আর সে গেল খোঁজ-খবর নিতে। সে এসে জানালো সব ভালো। হল ম্যানেজার তাকে আশ্বস্ত করেছে এত ভালো সিনেমা কয়েক বছরে এই সিনেমা হলে আসেনি। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম, কারণ সাথে বেশ কয়েকজনা মেয়েও ছিল। 
সবাই খুব এক্সাইটমেণ্ট নিয়ে হলে ঢুকলাম। ততক্ষণে প্রায় আধঘণ্টা পেরিয়েছে সিনেমা শুরু হয়েছে। সিনেমার নাম “জটিল প্রেম”। আমরা হলে ঢোকার মুখে একটু ধাক্কা খেলাম, কি নোংরা রে বাবা! যাই হোক একেবারে উপরে স্পেশাল বক্সে আমাদের টিকেট কাটা ছিল। সবাই সিটে যখন বসছি তখন স্ক্রিনে একটা আইটেম সঙ চলছিল, গানের লিরিক্স শুনে হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা... “আমার কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকছে, মাথা আমার নষ্ট...” পুরাই লুল। 
যাই হোক আশেপাশে খেয়াল করতে দেখি উপরে আমরা ছাড়া আর কোন দর্শক নেই! আমরা বুঝলাম এই জেলা শহরে নিশ্চয়ই আমাদের মত পাগল কেউ নাই যে নাইট শোতে সিনেমা দেখতে আসবে। গান শেষে সিনেমা’র গল্প বুঝার চেষ্টা করলাম। সিনেমার নায়িকা হল এক বিরাট ব্যাবসায়ি নেতার মেয়ে, নায়িকার ভাই বিরাট টেরর। নায়িকার বিবাহের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে, কিন্তু নায়িকা বিয়ে করতে রাজী নয়। কিন্তু বাবা আর ভাই তাকে চেপে ধরে কেন সে বিয়ে করতে রাজী নয়। নায়িকা বিয়ের হাত থেকে বাঁচতে মিথ্যা বলে, সে কাউকে ভালোবাসে। আর যায় কোথায়, ভাই চেপে ধরে ছেলের নাম কি? নায়িকা কিছু ভেবে পায় না কি বলবে। ঠিক তখন ড্রয়িং রুমের সেন্টার টেবিলে দেখে “জীবন” মিনারেল ওয়াটারের বোতল। এই তো, নাম পাওয়া গেছে, ছেলের নাম জীবন। হাসতে হাসতে মাথা ব্যাথা... 😜 
এরপর নায়িকার ভাই ঢাকা শহরে যেখানে যত জীবন নামের ছেলে আছে সবাইকে ধরে ধরে পেটাতে আরম্ভ করে। এই করতে করতে একসময় সে আরেক বড় টেররের ছেলেকে পেটায়, আর এতে করে ক্ষেপে যায় ঐ টেরর। প্রতিশোধ নিতে নায়িকাকে কিডন্যাপ করতে ধাওয়া করে, নায়িকা বাঁচতে প্রাণপণ দৌড়... এই সময় নায়কের আবির্ভাব... কিন্তু কোথায়? হাসতে হাসতে চোখ ব্যাথা... 😜 
নায়ক হাতিরঝিলে... কোন এক চারাগাছের গোঁড়ায় জলত্যাগ করছে... এটা নায়কের প্রথম দৃশ্য পুরো ছবিতে... রুচিশীল স্ক্রিপ্ট রাইটার বটে... এটুকু হলেও চলতো, কিন্তু এরপরের দৃশ্যে নায়িকা দৌড়াতে দৌড়াতে নায়ক জলত্যাগরত অবস্থায়ই নায়কের উপর গিয়ে পরে। ফলাফল? জলত্যাগের জায়গাতেই নায়িকাকে নিয়ে নায়কের চিৎপটাং হওয়া... মাইরালা কেউ আমারে মাইরালা... :😜 
স্টকে থাকা সবটুকু ধৈর্য শেষ করে অনেক কষ্টে আধঘণ্টা’র মত সিনেমা দেখে হল থেকে বের হলাম। পরেরদিন সকালে খুব ভোরে বের হলাম গজনী, মধুটিলা ঘুরতে... কিন্তু গাড়ীতে সারাক্ষণ ছিল দুটি শব্দ “জটিল প্রেম” আর “আমার কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকছে, মাথা আমার নষ্ট...”। মনে মনে বললাম, মাফও চাই, দোয়াও চাই... আর দেখতাম না ছি!নেমা.. 
ও আরেকটা কথা হল থেকে বের হওয়ার সময় দেখি নীচেও কোন দর্শক নেই। তারমানে আমরা কয়েকটা বোকা ছাড়া আর কেউ নেই পুরো সিনেমা হলে... শেষে হোটেলে এসে রাত দেড়টা পর্যন্ত আমার রুমে কিছু নিয়মিত ভ্রমণবন্ধু আড্ডায় মেতে রইল। এতো লম্বা জার্নি শেষেও ক্লান্তি নেই, যদিও মনা ভাই বলে দিয়েছে সকাল সাতটায় আমরা রওনা দিব তারপরও ঘুমোতে গেলাম রাত দুটোয়।
সকাল পাঁচটায় টুটু ভাইয়ের হাঁকডাকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হল। ছয়টা নাগাদ রেডি হয়ে রুম তালা মেরে নিচে রিসিপশনে এসে দেখি কোথাও কেউ নেই। একে একে সবাই রেডি হয়ে জড়ো হতে হতে সাড়ে ছয়টার উপরে, তড়িঘড়ি করে গাড়ী ছাড়া হল। ঘণ্টাখানেক চলার পর গাড়ী থামানো হল সকালের নাশতা করে নেয়ার জন্য। লোকাল এলাকায় ১৫-২০ জনের জন্য নাশতা তৈরি করে সার্ভ করা একটু ঝামেলার। এখানে ঘণ্টাখানেক নষ্ট করে আমরা আবার রওনা হলাম। 
প্রথমে আমরা গেলাম জামালপুরস্থ (শেরপুর হতে বেশ কাছে) “লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্র”। দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। শাল আর গজারি বন আচ্ছাদিত ঘন সবুজের পাহাড়ের চূড়ায় সাদা মেঘের ভেসে বেড়ানো, ছোটাছুটি ও লুকোচুরি খেলা। নীল আকাশের কোলে হেলে থাকা পাহাড় আর সবুজ প্রকৃতির ফাঁকে ফাঁকে স্বচ্ছ জলের আঁকাবাঁকা লেকের বাহার। 
আলো-আঁধারির এসব লেকে রাজহংস পালের জলকেলিতে মাতামাতি। লেকের ওপর ঝুলন্ত ব্রিজে হিমশীতল বাতাসের পরশে গা জুড়ানো। লেক ঘেঁষা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে পিচঢালা দীর্ঘ আঁকাবাঁকা ছায়াসরুঁ পথ। সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার দেবদারম্নবেষ্টিত সর্পিলাকার সিঁড়িপথ পেরিয়ে পাঁচতলার ওয়াচ টাওয়ার। ক্রিসমাস ট্রিতে ঘেরা দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল ডাকবাংলো, শিশুদের দোলনা। 
পাহাড় আর টিলায় টিলায় গারো আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা। জামালপুরের 'লাউচাপড়া' অবসর বিনোদন কেন্দ্রের এই নৈসর্গিক ও ছায়াশীতল পরিবেশ দর্শনে বছরজুড়ে ভিড় করছেন দেশ-বিদেশের শত শত পর্যটক। জামালপুর জেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা বকশিগঞ্জ। আর শেরপুর জেলা সদর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা শ্রীবর্দী। অবসর বিনোদন কেন্দ্র লাউচাপড়ার অবস্থান বকশিগঞ্জ উপজেলার 
পাহাড়ি জনপদে হলেও শ্রীবর্দী উপজেলার কর্ণজোড়া বাজার থেকেও বেশি দূরে নয়। বকশিগঞ্জ থেকে ১৫ আর শ্রীবর্দী থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরের পর্যটন কেন্দ্র লাউচাপড়া। বকশিগঞ্জ ও শ্রীবর্দীর দু'টি পথ এক হয়ে মিলেছে চোখ জুড়ানো অপার সৌন্দর্যের আধার বলে খ্যাত লাউচাপড়ায়। এক সময় ঘন বন জঙ্গলের এসব পাহাড়-টিলায় শত প্রজাতির বন্যপ্রাণী থাকলেও এখন তা কমে গেছে। শূকর, বানর, বনমোরগ আর হাতির পাল ছাড়া এই বনে তেমন কোন প্রাণীর দেখা মেলে না এখন। তারপরও প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের ভিড়ে বছরজুড়ে উৎসবমুখর থাকছে ছায়াশীতল নৈসর্গিক লাউচাপড়া।
এখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে আমরা রওনা হয়ে গেলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য "গজনী অবকাশ যাপন কেন্দ্র"র উদ্দেশ্যে।             

ভ্রমণকালঃ ২৪ মে, ২০১৩

আগের পর্ব পরের পর্ব

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ