হাইওয়ের পাশে দুটি আধপাকা কামড়া, সামনে সরু কাঁচা রাস্তা গিয়ে মিশেছে গ্রামের ভেতরে দুই পাশে রেখে দিয়ে দুটি পুকুর। পুকুর পাড়ে দড়ির দোলনায় মাঝে মাঝে দোল খেয়েছি। কেউ কেউ পাড়ে ভেড়ানো ছোট্ট নৌকায় করে ঘুরে বেড়িয়েছে রাতের কুয়াশার আলো-আধারীতে। মুরগী ঝলসানো শেষ হলে গরম পরাটা আর ইয়াম্মী সালাদ এর সাথে চলল রসিয়ে রসিয়ে ঝলসানো মুরগী গলধঃকরণ। আকাশে আধটুকু ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ, কুয়াশার চাদর ভেদ করে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিল।
গত মাস দুয়েক কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না। রাজনৈতিক বিশৃংখলা আর টানা অবরোধের গ্যাড়াকলে পরে ছুটির দিনগুলো এমনি এমনি অতিবাহিত হচ্ছিল। আমরা ভ্রমণপ্রিয় বন্ধুরা প্রচন্ড হতাশ হচ্ছিলাম। ভ্রমণ বাংলাদেশ ভ্রমণ বাংলাদেশ এর বাৎসরিক মেগা ইভেন্ট “স্বপ্নের সৈকতে একেঁ যাই পদচিহ্ন: Hiking & Camping: World's longest Beach-2013” দুই মাস পিছিয়ে দিতে হয়েছে এই প্রতিকূল পরিবেশের জন্য। তো ভ্রমণপাগল বন্ধু মনা গত সপ্তাহে ফেবুতে স্ট্যাটাস দিল যে আগামী বড়দিনের ছুটিতে ভ্রমণ বাংলাদেশের উদ্যোগে সারারাত ব্যাপী আড্ডা সাথে বারি-বি-কিউ বড় ভাই পলাশ এর কেরানীগঞ্জস্থ খামারবাড়ীতে। পরদিন থাকবে তদসংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা সাথে ফটোওয়াক। গত বছর বড়দিনে অফিস খোলা ছিল, তবে সৌভাগ্য আমার এবার অফিস ছুটি রয়েছে বড়দিনে।
তো মঙ্গলবার বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ফ্রেশ হয়ে স্লিপিং ব্যাগ, শীতের কাপড় ইত্যাদি গুছিয়ে নিতে নিতে ভ্রমণ বাংলাদেশ এর সভাপতি টুটুল ভাই ফোন দিলেন, তার সাথে মোটর বাইকে করে পলাশ ভাই এর কেরানীগঞ্জস্থ খামারবাড়ীতে রওনা হলাম। প্রচন্ড শীতে মোটরবাইকে করে জার্নি পুরো পথে খুব পেইন দিল। রাত আটটা নাগাদ আমরা পৌছে গেলাম আবদুল্লাহপুর বাজারে। এখানে মনা, পলাশ ভাইসহ আরও দুই নতুন ভ্রমণসাথী আগে থেকে অপেক্ষা করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে রনী, সুমন, শরীফ এরা তিনজন চলে আসলে আমরা সবাই রওনা দিলাম পলাশ ভাই এর খামারবাড়ীর দিকে যেখানে আগে থেকে চলে এসেছে আরও পাঁচজন আড্ডার সাথী। সেখানে পৌছে দেখি মুনিরুল আরও একজনকে সাথে নিয়ে মুরগীর মাংস কাটাকুটি নিয়ে ব্যাস্ত, তার সাথে মহিলা মহলের আপা আর ভাবীরা বার-বি-কিউ মসলা তৈরীতে ব্যাস্ত। একে একে সকল ভ্রমণসাথীই রাত দশটার মধ্যে এসে হাজির হল আড্ডাস্থলে। হালকা নাস্তা আর টুকটাক গল্পে এই সময়টুকু পার করে দিলেও দশটার পর সবাই ব্যাস্ত হয়ে পড়ল বার-বি-কিউ প্রস্তুতিতে। আগুণ জ্বালানো, কয়লা গরম করা, এরপর তাতে মুরগী ঝলসানো… … সাথে চলল গান আর আড্ডা।
রাত একটার উপরে বেজে গেল খাবার শেষ করতে করতে। খাবারের সাথে ছিল কোমল পানীয় আর কফি। রাত প্রায় তিনটা পর্যন্ত চলল আড্ডা। শেষে কেউ তাবুতে কেউবা ঘরে চলে গেলাম ঘুমোতে। আমি, সুমন, মুনিরুল, রনী আর শরীফ একটি বড় তাবুতে ঢুকলাম। একফাঁকে তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
সকাল ছয়টা নাগাদ ঘুম ভেঙ্গে গেল, তাবু হতে বেড়িয়ে দেখি চারদিকে কুয়াশার আঁধারীর মেলা জমেছে। কাঁচামাটির পথ ধরে হাটতে লাগলাম। গ্রামের পথ দিয়ে মিনিট বিশেক হেটে এসে যখন ভাবছি একটু ঘুমিয়ে নিব কি না, তখন শ্রদ্ধেয় সেলিনা আপা রুম হতে বেড়িয়ে এলেন হাটতে বের হবেন বলে। আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন সাথী হতে। শুরু করলাম আবার হাটা। কুয়াশাময় শীতের সকাল দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম নদীর ধারে। জমাট কুয়াশা দশ হাত সামনের জিনিশও চোখের আড়াল করে রাখছে। ঘন্টাখানেক ঘুরে ফিরে আসলাম নীড়ে।
একে একে সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠতে লাগল, আমি পুকুরপাড়ে দোলনায় দোল খেতে খেতে দেখি পলাশ ভাই আমাদের দুপুরের ভূঁড়িভোজের জন্য মাছ ধরতে পুকুরে লোক নামিয়ে দিয়েছেন। জাল ফেলে মাছ ধরা দেখতে দেখতে কতটা সময় গড়িয়েছে জানিনা, একসময় দেখি সবাই রেডী, চললাম নাস্তা খেতে। নাস্তা শেষে শুরু হল আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা। পাশের বেদে পল্লী, প্রায় আট কিলোমিটার দূরে বড়দিনের সুসজ্জিত চার্চ পরিদর্শন, সরিষা ক্ষেতের আদিগন্ত ছড়ানো রূপ আর এরই মাঝে চলল আমাদের ফটোওয়াক।
মধ্যদুপুরে ফিরে এলাম পলাশ ভাই এর খামারবাড়ীতে। সবাই ফ্রেশ হয়ে বসে পড়লাম পলাশ ভাইয়ের স্ত্রী তথা ভাবীর হাতের রান্না করা সবজি, সকালবেলা পুকুর হতে ধরা তাজা মাছের তরকারী আর ডাল নিয়ে। খুব মজা করে খেলাম, এরপর কিছক্ষণ অলস আড্ডা দিয়ে বিকেল চারটার দিকে পলাশ ভাইদের কাছ হতে বিদায় নিয়ে সকলে রওনা হলাম বাসার দিকে। রেখে গেলাম চব্বিশ ঘন্টার মধুর স্মৃতিময় সময়। আর হ্যাঁ যে কথাটি বলা হয়নি, আমাদের এই আড্ডার ছোট্ট দুই সাথী ছিল পলাশ ভাইয়ের আট বছর বয়সী মেয়ে প্রভা আর মেহেদী ভাইয়ের দুই বছরের ছোট্ট ছেলে আবদুল্লাহ্। এ দুজন সাথী প্রায় রাত দু’টা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গী হয়ে জেগেছিল। ধন্যবাদ ভ্রমণ বাংলাদেশ পরিবারকে এমন একটি চমৎকার আয়োজনের জন্য।
গল্পের ছবিসকল
জ্বলছে আগুন, শীতের রাতে
চলছে বারবিকিউ
মুরগী পোড়া শেষে
রাতের বেলা সবাই আড্ডা আর মাস্তিতে
কুয়াশামাখা ভোরবেলায় ব্রীজের উপর থেকে দেখা তীরে ভেড়ানো নৌকার সারি