হিড়িম্বা দেবী টেম্পল - মানালি ভ্রমণ

সেবারের মানালি ভ্রমণে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল হিড়িম্বা দেবী টেম্পল এবং তদসংলগ্ন বনবিহার। ইতিহাসে এই হিড়িম্বা দেবী রাক্ষসী হিসেবে উল্লেখিত থাকলেও স্থানীয়দের কাছে হিড়িম্বা দেবী "মা হিড়িম্বা" হিসেবে পূজিত হন। কথিত আছে রাক্ষস হিড়িম্ব আর তার রাক্ষসী বোন হিড়িম্বা বর্তমানের মানালির এই বনে বসবাস করতেন। মহাভারত এর পঞ্চ পান্ডব যখন দূর্যোধনের ছলনা থেকে বাঁচতে পালিয়ে যান; তখন তারা এই বনে আশ্রয় নেন। আর রাক্ষস হিড়িম্ব এই খবর পেয়ে তার বোন হিড়িম্বাকে এক অনিন্দ্য সুন্দরী রমনীর রূপ ধরে তাদের নিকট পাঠান; উদ্দেশ্য মানুষ শিকার করা। দাদার আদেশে হিড়িম্বা যান পঞ্চ পান্ডব এর কাছে তাদের বধ করতে। কিন্তু প্রথম দর্শনেই পঞ্চপান্ডবের মধ্যম জন ভীম'কে তার ভাল লেগে যায়। হিড়িম্বা ভীমকে বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। আর ঐদিকে ভাই হিড়িম্ব বোনের ফিরতে দেরী দেখায় সেখানে যান এবং গিয়ে এই বিয়ের খবর শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে তার নিজ বোনকে হত্যা করতে উদ্যত হলে হিড়িম্বর সাথে পঞ্চপান্ডবের যুদ্ধ হয় এবং তাতে হিড়িম্বকে বধ করেন ভীম। পরবর্তীতে কুন্তির আদেশে ভীম বিয়ে করেন এই রাক্ষসী হিড়িম্বাকে। তবে তাতে একটা শর্ত ছিল, সন্তান হওয়ার পর ভীম ত্যাগ করবেন হিড়িম্বাকে। সেই অনুযায়ী সন্তান ঘটোৎকচ এর জন্ম  হওয়ার পর ভীম পঞ্চপান্ডবের সাথে মানালির সেই জঙ্গল ত্যাগ করলেও হিড়িম্বা দেবী রয়ে যান সেখানে এবং সন্তানকে নিয়ে গভীর তপস্যায় নিমজ্জিত হন এই মন্দিরে। 

মানালির পাইন আর দেবদারু'র বনে প্যাগোডা আকৃতির এই মন্দির এ শতশত পর্যটক প্রতিদিন ভ্রমণে আসেন এবং অতি অবশ্যই হিন্দু ধর্মালম্বী'রা এখানে পূজোটাও সেরে নেন। আমরা সেখানে পৌঁছে দেখলাম সুবিশাল লাইন, আমাদের দলের মিতা রয় পূজোর লাইনে দাঁড়ালে আমরা বাকীরা আমাদের মত করে চারিপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। 


হিড়িম্বা দেবী'র স্মৃতি উদ্দেশ্যে এই মন্দিরের উৎপত্তি। দেবদারু গাছে ছেয়ে থাকা বনভূমি’র ভেতরে বিশালাকৃতির এক পাথুরে চত্বরের উপর এই মন্দির নির্মিত হয় ১৫৫৩ সালে। চারিদিকে কাঠের অবকাঠামো দিয়ে ঘেরা এই মন্দির এর উপরে একটি শিখর আকৃতি রয়েছে। ছাদের দিকে তিনটি স্তরে চতুষ্কোণাকৃতির ছাদ ক্রমান্বয়ে আকারে ছোট হয়ে উপরে উঠে গেছে, তার উপর শিখর।

এই মন্দিরের ভেতরে একটি বিরাট কালো পাথর রয়েছে যেটাতে বসে হিড়িম্বা দেবী গভীর তপস্যায় নিমজ্জিত হন বলে কথিত রয়েছে। পুরো মন্দির চত্বরটির পুরোটাই কাঠের কারুকাজ এ নির্মিত। মন্দিরটি সাজানো রয়েছে বিভিন্ন পশুর শিঙ দিয়ে, ধারণা করা হয়ে এই পশুগুলো হিড়িম্বা দেবীর উদ্দেশ্যে বলিকৃত। এই মন্দিরের অভ্যন্তরে রয়েছে এক বিশাল পায়ের ছাপ; স্থানীয়দের বিশ্বাস এই পায়ের ছাপ হিড়িম্বা দেবীর। সাধারণত নবমীতে যখন দুর্গাপূজা করা হয়ে; ঠিক ঐ সময়েই মানালিতে এই দেবী হিড়িম্বা পূজা হয়। 

মন্দিরের চারিধারের পাইন আর দেবদারু গাছের ঘন বন এর মাঝে অদ্ভুত এক আলো আধারির খেলার মাঝে কাঠের এই চৌকোনাকৃতির মন্দির এই অতিপ্রাকৃত আবহ'র সৃষ্টি করে। হিড়িম্বা দেবীর মন্দির থেকে একটু এগিয়ে গেলে তুলনামূলক ছোট আরেকটি মন্দির দেখা যায়; যেটি হিড়িম্বা দেবী আর ভীম এর সন্তান এর। মহাভারত অনুযায়ী কুরুক্ষেত্র এর যুদ্ধে পঞ্চপান্ডব এর পক্ষে যোগ দিয়ে নিহত হয় সে।

মন্দিরের পেছনের দিকে এক পাশে বড় ডেকচিতে রান্না হচ্ছিল; জিজ্ঞেস করতে জানা গেল মন্দিরের দর্শনার্থীদের জন্য রান্না হচ্ছে প্রসাদ। মন্দিরের চারিপাশ ঢুঁ মেরে আমি এগিয়ে গেলাম দেবদারু আর পাইনের বনের দিকে। আপনমনে বেশ কিছুটা সময় একাকী এখানে ঘোরাঘুরি করে মন্দিরের প্রবেশ অংশের দিকে ফুটপাথে বসা নানানরকম দ্রব্য নিয়ে বসা দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে কাটাতে লাগলাম। কিছুটা সময় পরে দলের আরও দুই সদস্য আমার সাথে এসে এখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম মিতা রয় এর পূজো শেষে ফিরে আসার। কিছু সময় পর সেও ফিরে এলে আমরা সেখান হতে পা বাড়ালাম পরবর্তী গন্তব্য 'গাধান থেকচ্ছক্লিং গুম্পা মনস্ট্রি'র দিকে।

 

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ