মানালি টু দিল্লী যাত্রা
মানালি থেকে দিল্লী, সড়কপথে প্রায় সাড়ে পাঁচশত কিলোমিটার এর রাস্তা। টানা ১৪ দিনের ভ্রমণ শেষে আর যেন মন টিকছিলো না এই বিদেশ বিভূঁইয়ে। তাইতো আমাদের ড্রাইভার বিপিন যখন গতরাতে বললো, ভোররাতে রওনা দিবো আমরা দিল্লীর উদ্দেশ্যে; আমরা সবাই একবাক্যে রাজী হয়ে গেলাম। পকেটের অবস্থাও একেবারে টাই টাই ফিস অবস্থা। তাই আগের রাতে আমরা রাতের ডিনার শেষে নিজেদের ব্যাগপত্তর গুছিয়ে রেখেই ঘুমাতে যাই; যেন ভোররাতে ঘুম থেকে উঠেই গাড়ীতে চেপে বসতে পারি। ভালো কথা, রাতের ডিনারের একটা মজাদার গল্প না শেয়ার করে এই ভ্রমণ শেষ হলে অপূর্ণ থেকে যাবে। আমরা মানালিতে ছিলাম আমরা মোট ০৪ রাত; আর যে হোটেলে ছিলাম সেটি ছিল Hotel Century Gangri এবং আমাদের সকালের নাস্তা এবং রাতের খাবার প্যাকেজের অন্তর্ভূক্ত ছিল। তো এখানে প্রতিদিন একই ধরনের খাবার খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম; একই মেন্যু প্রায়ঃ রুটি, ভাত, আলু-গোবি, মাটার পানির, পানির গ্রেভি, রাজমা, ঘন ডাল, টক দই, সালাদ। যদিও আতিথিয়তায় কোন কার্পন্য ছিলো না। প্রতিবার খাবার সময় গরম গরম রুটি পরিবেশন করতো; অল্প পরিমানে সার্ভ করে শেষ হলে আবার গরম রুটি নিয়ে আসতো। খাবারের স্বাদও মজাদারই ছিলো। কিন্তু এইসব ভেজিটেরিয়ান আইটেম আর কত ভালো লাগে। তো আমাদের এক আপু কিচেনে গিয়ে শেফ মহোদয়কে আগের দিন রিকোয়েস্ট করে এসেছিলেন আমাদের কোন মাছের আইটেম দেয়া যায় কি না। উনি বললেন মাছ তো পারবেন না; তবে ডিমের কারি করে দিবেন। রাতের বেলা খুব আগ্রহ নিয়ে খাবার টেবিলে গেলাম; খুব সুন্দর করে ঢেকে পরিপাটি করে আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত ডিশ এলো। সেই আগ্রহ ধরে রেখে ডিশ খুলে দেখি প্রতিদিনের বাটার পনির এর গ্রেভিতে দুইটা ডিম সিদ্ধ করে চার টুকরো করে সেই গ্রেভিতে বসিয়ে দিয়েছে। হায়রে... দুঃখ রাখি কই। শেফ ব্যাটা আবার এসে জিজ্ঞেস করে গেল, আমরা খুশী হয়েছি কি না! মনে মনে তার গুষ্ঠি উদ্ধার করলেও মুখে হাসি ধরে রাখলাম।
ভোররাতে যখন আকাশে আলোর রেখাও ফুটে নাই, আমরা মানালি থেকে রওনা হলাম দিল্লীর পথে। গাড়ী চলতে থাকলো অন্ধকার রাতের মানালির পাহাড়ি পথ ধরে; চারিধার যখন সুখনিদ্রায় শায়িত, আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি নিস্তব্ধ প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য। আমার মোবাইলে একটু পরপর ভিডিও করছিলাম; মিনিট দুয়েক হাত বাইরে রাখতেই ঠান্ডায় যেন জমে যাচ্ছিল; তার সাথে দলের সবার চিৎকার, বকাঝকা... কনকনে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে যে। কিন্তু এত্ত কষ্ট করে করা শতাধিক ভিডিও সব হারিয়ে গিয়েছিলো ঢাকায় ফিরে আমার সপ্তাহখানেক এর মধ্যে আমার মোবাইলখানা পকেটমার হওয়াতে। ভাগ্যের লিখন, যায় না খণ্ডন! 😭
ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুটতে শুরু করলে পাহাড়ি পথের অপার্থিব সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে দেখছিলাম চারিধার। অনেকটা সময় পর একটা টানেলে প্রবেশ করলো আমাদের গাড়ী। দুই লেনের এই টানেলের দুই পাশেই মানুষ হাঁটার জন্য ফুটপাথ রয়েছে এবং দেখলাম এই সাত সকালে একজন মধ্যবয়সী লোক সেই পথ ধরে এই শীতের মাঝে হেঁটে যাচ্ছে। বিপিন'কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম টানেলের দুই প্রান্তের এলাকার মানুষ চলাচলের জন্য এই টানেলের পথকেই বেছে নেয়। আসলে পাহাড়ে জীবনের রূপ একেবারে ভিন্ন। সিমলাতে দেখেছিলাম পাহাড়ী রাস্তার ঢাল ধরে একসারিতে গাড়ী পার্কিং করার ব্যবস্থা। সেখান থেকে হয়তো কারো কারো বাসা এক দুই কিলোমিটার উপরে। প্রতিদিন এভাবেই তারা চলাচল করে অভ্যস্ত। আর আমরা যারা সমতলের বাসিন্দা, আমাদের জন্য পাহাড়ী পথে পাঁচশত মিটার চলতেই খবর হয়ে যায়।
পথিমধ্যে আমরা সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। একসময় গাড়ী পাহাড়ি রাস্তা ছেড়ে সমতলের পথ ধরলে আমি চোখ মুদিলাম। কিছু সময় পর চেয়ে দেখি গাড়ী চলছে পাঞ্চাবের হাইওয়ে ধরে, মানালি থেকে কুল্লু-মান্ডি-বিলাসপুর হয়ে চন্ডীগড় অতিক্রম করছে। এই দশ লেনের হাইওয়ে খুব মনে ধরেছিলো। গাড়ী চলছিলো, আমি দেখলাম আমাদের গাড়ীর স্পিডোমিটার বলছে গাড়ী চলছে ৯০ কিলোমিটার গতিতে। কিন্ত মনে হচ্ছিলো না সেরকম। বিপিনকে বললাম, তোমার স্পিডোমিটার ঠিক আছে তো? সে কারণ জিজ্ঞেস করে জানতেই একটা হাসি দিয়ে বলল, বাইরের নোটিশগুলো লক্ষ্য করো। দেখলাম কিছুদূর পরপর প্রতিটি ভেহিকেলের ধরণ অনুযায়ী স্পীড লিমিট সেট করা আছে; প্রতিটি ভেহিকেল সেই গতিতেই চলতে হবে; তার কমবেশী হলেই জরিমানা; সিসি ক্যামেরা সেট করা আছে। ভারতের হাইওয়েগুলোর কর্মকান্ড পছন্দ হয়েছিলো। হাইওয়েতে বিশ ত্রিশ কিলোমিটার পরপর টোলঘর, সেখানে ১০ রুপী থেকে ৮০ রুপী পর্যন্ত টোল দিতে হচ্ছিলো আমাদের ফোর হুইলার ফোর সিটার গাড়ীটিকে। বিপিনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম দিল্লী-সিমলা-মানালি-দিল্লী পথে তাকে মোট ১,৬৫০ রুপীর মত টোল দিতে হয়েছিলো। আর সেই টোলের টাকায় সারাটা পথের কার্পেটিং ছিলো চোখে পড়ার মত। সত্যি বলতে একটা বারের জন্যেও কোন খানাখন্দ দেখতে পাই নাই। আর বিপিন এর ড্রাইভিং কি বলবো। এক সপ্তাহের এই যাত্রাপথে একবারের জন্যেও হার্ডব্রেক বা হুট করে টার্ন করা এমন কিছুই দেখি নাই। রাতে সিমলার পাহাড়ি পথে অথবা ভোররাতের আঁধারের মাঝে মানালির পাহাড়ি বাঁকে অবলিলায় ৭০-৮০ কিলোমিটার স্পীডে গাড়ি চালিয়েছে। একবারের জন্য কোন ঝাঁকুনি ফিল করি নাই। সিমলায় যাওয়ার দিন বেশ কয়েকবার গাড়ীর বডিতে 'খট' করে শব্দ হয়েছিল এবং প্রতিবারই সে গাড়ীর গতি কমিয়ে বুঝার চেষ্টা করছিলো সমস্যা কোথায়। বেশ পরে আবিস্কার হলো আমাদের দলের এক সঙ্গী জানালার উপরে রাখা মুভেবল হাতল ধরে রেখে একটু পরপর ছেড়ে দিচ্ছিলো এবং সেটা হতে সেই শব্দ'র উৎপত্তি। বিপিন গাড়ী একটা সাইডে থামিয়ে সুন্দর করে সবাইকে বুঝিয়ে বলেছিলো এমনটা না করতে, কারণ যে কোন শব্দ হলেই তাকে চেক করতে হবে, গাড়ীতে কোন সমস্যা দেখা দিলো কি না! এই পাহাড়ি পথে ড্রাইভিং এর জন্য প্রতি বছর চক্ষু এবং মানসিক দুটো ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে হয়ে তাদের। সাধারণত হিমাচলে যে সকল রোড এক্সিডেন্ট এর খবর দেখা যায় তার বেশীরভাগই হিমাচলের বাইরের গাড়ী আর নইলে কোন পাহাড় ধ্বসের কারণে হয়। হিমাচলের লোকাল গাড়ী এক্সিডেন্ট এর হার একেবারেই নগণ্য।
বেলা বারোটা নাগাদ আমাদের গাড়ী একটা রোদ সাইড ধাবাতে থামানো হলো। নামেই ধাবা, এটা আসলে কোন ফাইভ স্টার হোটেল হতে কম না। পরে জানলাম এটা থ্রি স্টার ক্যাটাগরির হোটেল কাম রোড সাইড রেস্টূরেন্ট। এর ওয়াশরুম ব্যবহার করতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। শতভাগ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং দুজন সার্বক্ষনিক ক্লিনার দাঁড়িয়ে প্রবেশমুখে। প্রতিবার কোন গেস্ট ব্যবহারের পরপরই তারা গিয়ে সব কিছু চেক করে আবার মপ দিয়ে ফ্লোর পরিস্কার করে দিচ্ছে। আর আমাদের হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট এর কথা ভাবলেই দুঃখ হয়। মন খারাপ হলো এখানে লাঞ্চ করা হলো না বলে; কেননা সবেমাত্র বারোটা বাজে।
দুপুর দুইটা নাগাদ "চাচে দা পাঞ্জাবী ধাবা" নামক এক ধাবায় গাড়ী থামানো হলো। এখানে খেলাম বাটার নান, মিক্সড সবজি, নুডুলস আর চা। তবে এখানে খাওয়া বাটার নান রুটিটা আমার এই পর্যন্ত খাওয়া সবচাইতে বেস্ট নান ছিল। তুলোর মত নরম, মুখে দিলেই যেন গলে যাচ্ছিল; তার সাথে বাটারের সুঘ্রাণে মৌ মৌ করছিল চারিপাশ। দুঃখ কেন আরও দু'চারটা রুটি খেলাম না সেদিন। তো সেখান হতে আমাদের গাড়ী এবার কুরুক্ষেত্র এর পথ দিয়ে চলতে লাগলো দিল্লী অভিমুখে। দুপুর শেষে প্রথম বিকেলের নরম রোদে হালকা গরম লাগছিলো; বিপিনকে বলতে এসি চালু করে দিলো। এই তো শেষ পথচলা এবারের ট্যুরে। কিছুসময় পরেই বিপিনকে বিদায় দিয়ে আমরা রাতটা কাটাবো দিল্লীতে। এরপর পরের দিন পথ ধরবো ঢাকার উদ্দেশ্যে।
মন্তব্যসমূহ