নবমী'র রাতে দিল্লীতে, দশমীতে বিদায়

সন্ধ্যের আগে আগে শেষ বিকেলে আমরা পৌঁছে গেলাম দিল্লী; প্রায় তেরো ঘন্টায় সাড়ে পাঁচশত কিলোমিটার এর বেশী পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের আজকের গন্তব্য কেরলবাগের নিকটবর্তী ফয়েজ রোড; এখানে বিপিন এর পূর্ব পরিচিত একটা হোটেলে সরাসরি সে নিয়ে এলো। রুম দেখে আমাদের পছন্দ হলে আমরা আট দিনের সাথী, রাজপুতান বংশের বেটে খাটো বিপিন এর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমার ভারত ভ্রমণের গাড়ীর ড্রাইভারগুলো খুব মজার চরিত্রের পেয়েছিলাম; শুধুমাত্র একবার একটা বদ ড্রাইভার ভাগ্যে পড়েছিলো। ভারতের ট্রাভেল কোম্পানী বা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীগুলোর ড্রাইভারদের জীবনটা বড়ই অদ্ভুত। তিন-পাঁচ-সাত দিন থেকে শুরু করে কখনো কখনো এক মাসের ট্রিপ নিয়েও তারা বেড়িয়ে পড়ে। সারাদিন নানান গন্তব্য ভ্রমণ করিয়ে রাতে গেস্টদের হোটেল লাগোয়া পার্কিং এ গাড়ি পার্ক করে সেখানে নিজের মত করে থাকা-খাওয়া-গোসল সহ নিত্যকার কর্ম সকলের অগোচরে সুন্দর সেরে নেয়। খুব দামী হোটেল না হলে সহজে ড্রাইভারদের থাকার কোন সুবিধা দেয়া হয় না হোটেল থেকে। এই ড্রাইভারেরা খুব সাচ্ছন্দে গাড়ীতেই দেয় আরামসে ঘুম; বিছানাপত্তর থাকে গাড়ীতেই। আলাদা একটা পর্দার মত থাকে, যা দিয়ে গাড়ীর চারিদিক তারা খুব সুন্দর করে ঢেকে দেয় ভেতর থেকে।

আমাদের বিপিন মশাই ছিলেন রাজপুতান ঘরনার অতি ধার্মিক মানুষ, এই এক সপ্তাহ উনার ব্রত ছিল। সারাদিনে পানি, চা আর নিজস্ব কিছু ফলাহার ব্যতীত অন্য কোন খাদ্য তিনি গ্রহণ করেন নাই। তবে মানুষ ছিলেন রসিক; প্রথমদিন দিল্লী এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের গ্রহণ করে গান ছাড়া নিয়ে তার মজা নেয়া, রোহটাং পাসে আমার শীতে কাবু হওয়া নিয়ে রসিকতা সহ তার মজাদার নানান আচরণে মজারই ছিলো গত আটদিনের গাড়ী জার্নিগুলো। একটু হলেও কেমন খারাপ লাগা কাজ করছিলো বিদায় এর সময়। তাকে হাজার খানেক রুপী বখশিস দিলাম, সে হয়তো আরও বেশী আশা করেছলো; আমাদের ইচ্ছেও ছিল; কিন্তু দীর্ঘ ষোল দিনের ভ্রমণ শেষে পকেটের অবস্থা একেবারে শূন্য। 

যাই হোক, হোটেলে চেকইন করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আজকের রাতের প্ল্যান লালকেল্লা গিয়ে "লাইট এন্ড সাউন্ড শো" দেখার; সেটা দেখে চাঁদনী চক এ ঘোরাঘুরি করে ভুবণখ্যাত 'কারিম'স' এ রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফেরা। আমরা চেকইন এর সময় আমাদের পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলাম হোটেলের রিসিপশন এ, রাতের ভ্রমণে বের হওয়ার সময় পাসপোর্টগুলো ফেরত নিতে গেলে কাউন্টার থেকে বললো পাসপোর্টগুলো হোটেলেই থাক। আমাদের ব্যাপারটা পছন্দ হলো না, কারণ জিজ্ঞেস করতে উত্তর এলো কাউন্টারের ডানপাশে একটা সোফায় বসে থাকা এক ষাটোর্ধ ভদ্রলোকের কাছ থেকে। আসলে উনি এই হোটেলের গোড়াপত্তন করেছিলেন; এখন তার ছেলেরা চালায়। উনি আমাদের বললেন, দেখো দিল্লী আর এখন দিল্লীর আদিবাসী'দের শহর নেই। এটা এখন সারা ভারতের নানান অঞ্চল থেকে আসা নানান কিসিমের মানুষের এক জগাখিচুড়ির শহর। দিল্লীর ক্রাইম রেট দিন দিন বেড়েই  চলেছে, পকেটমার, ছিনতাই এগুলো নিত্যকার ঘটনা। তোমাদের পাসপোর্ট হোটেলের জিম্মায় থাকলে তোমরা নিরাপদে থাকবে; প্রয়োজনে দামী কিছু থাকলে আমাদের লকারে ডিপোজিট করে যাও। শুধুমাত্র হোটেলের ভিজিটিং কার্ড সাথে রাখো; আর মানিব্যাগটা সাবধানে রাখবে। যে কোন বিপদে বা প্রয়োজনে যে কাউকে হোটেলের কার্ড দেখাবা অথবা এখানে দেয়া নাম্বারে ফোন করে কথা বলিয়ে দিবা; তারপর সব দায়িত্ব হোটেলের। বেশ ভালো লাগলো উনার কথা শুনে। উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম লালকেল্লার দিকে।

লালকেল্লায় দুটি শো হয়ে; একটা রাত সাতট থেকে আটটা, যেটার ধারা বিবরণী দেয়া হয় হিন্দিতে। অপরটি আটটা থেকে নয়টা, এটার ধারা বিবরণী দেয়া হয় ইংরেজীতে। আমরা সাতটার টা মিস করেছিলাম বিধায় আশেপাশের নানান রকমের দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে সময় কাটাতে লাগলাম। পুরাতন দিল্লীর এই এলাকায় আশার আগ পর্যন্ত মাথায় ছিলো না আজ নবমী; এমন কি দলে মিতা রয় থাকা সত্ত্বেও। হয়তো তার মনে ছিলো, আমরা কেউ জিজ্ঞেস না করায় কিছু বলা হয় নাই। সেখানে দেখলাম পূজোর শোভাযাত্রা যাচ্ছে, বেশ জাকজমকপূর্ণই ছিলো। তবে, তা অবশ্যই কলকাতার মতো নয়। ইচ্ছে আছে একবার দূর্গোপূজোর পুরোটা সময় কলকাতায় কাটানোর, তাদের সেই উৎসব উদযাপনের কর্মকান্ড নিজ চোখে দেখার। 


আটটার আগে আগে টিকেট করে সিকিউরিটি চেক শেষ করে আমরা প্রবেশ করলাম লালকেল্লায়। সারি সারি বেঞ্চ রয়েছে; একটু পেছনের দিকের বেঞ্চে আমরা সবাই বসলাম। এক সময় শুরু হল শো, সকল লাইট অফ করে কেল্লার ভেতরের নানান দালানগুলোতে নানান বর্ণের আলো ফেলে দেয়া হচ্ছিলো ধারা বিবরণী। কোনটা দেওয়ানে খাস, কোনটা মমতাজ মহল, কোথায় কি হয়েছিলো। তার সাথে ছিলো নানান ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড। দেখতে ভালোই লাগছিল; তবে আহামরি কিছু মনে হয় নাই। আর মনে হচ্ছিলো এই শো মূলত মুঘল সম্রাটদের চরিত্রের আয়েশী মদ্যপ এবং নর্তকীতে ঘেরা আমুদে জীবন এবং তাদের পতন এর একটি চিত্রনাট্য। মুঘল সাম্রাজ্যের বীরগাথা, ভারতবর্ষে তাদের অবদান কিছুই তেমন খুঁজে পেলাম না সেই শো'তে। আসলে বর্তমানে তো সারা ভারত জুড়েই মুঘল শাসকদের হেয় আর চরিত্রহীন প্রমাণের অপচেষ্টা খুব জোরালোভাবে চলছে।

নয়টার আগে আগেই আমরা বের হয়ে এলাম লালকেল্লা হতে। যতটা আগ্রহ নিয়ে গিয়েছিলাম এই "লাইট এন্ড সাউন্ড শো" দেখতে; অনেকটা হতাশ হয়েই বের হয়ে এলাম। এরপর খাবার পালা, সোজা চলে এলাম কারিম'স এ। একটা কম্পাউন্ডে বেশ কয়েকটা দোকান, সবকয়টা একই মালিকানার একই দোকানের বসার আয়োজন। আমরা ভীড় কম এমন একটা পছন্দ করে ঢুঁকে পড়লাম। প্রথমে ভাবলাম চেখে দেখা যাক কাবাব আর নান; খেয়ে আহামরি কিছুই মনে হয় নাই। আমি মেইন কোর্স হিসেবে খাসির বিরিয়ানি অর্ডার করলাম। মুখে দিয়ে ঢোক গিললাম... আক্ষরিক অর্থেই আমাদের পুরাতন ঢাকার যে কোন সাধারণ বিরিয়ানির দোকানের খাসীর বিরিয়ানিও এর চাইতে মজাদার; হাজী, নান্ন, হানিফ এদের কথা বাদই দিলাম। অথচ এই কারিম'স নিয়ে সারা দুনিয়ায় কত আলোচনা! টাইমস ম্যাগাজিন এর প্রচ্ছদ হয় এদের নিয়ে। আল্লাহ্‌ মালুম, হয়তো আমারই জিহবা'র স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। 

 

 

 

 

এরপর রাতের খাবার শেষ করে ট্যাক্সি যোগে চলে এলাম ফাইয়াজ রোডের আমাদের হোটেলে। তার আগে চাঁদনী চকের কিছু দোকানপাটে ঢুঁ মারার চেষ্টা চললো; যদিও নবমী উপলক্ষে প্রায় বেশীরভাগ দোকানপাটই বন্ধ ছিলো। যাই হোক, হোটেল রুমে পৌঁছে সকলে নিজ নিজ ব্যাগপত্তর গুছিয়ে একটু রাত করেই ঘুমাতে গেলাম; কারণ আমাদের দিল্লী থেকে দুপুর আড়াইটায় এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট কলকাতার আর সেখান থেকে রাত সাতটার ফ্লাইটে রওনা হবো ঢাকা। 

সকালে একটূ দেরী করেই ঘুম থেকে উঠলাম; ফ্রেশ হয়ে হোটেলের পাশেই এক স্থানীয় রেস্টুরেন্টে 'আলু পারাঠা উইথ মাকখান' দিয়ে ভরপেট নাস্তা করে নিলাম। নাস্তার পর ফ্রি টাইম, এমন সময় মিতা এসে বললো, তার তো চকলেট কিনতে হবে; ভাই-বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নি এদের দেয়ার জন্য। আশেপাশে কোন দোকান খোলা দেখতে না পেয়ে কি করবে বেচারা ভেবে পাচ্ছিলো না। আমি কি মনে করে যেন, মানালিতে আমরা যে হোটেলে ছিলাম, তার সামনে থাকা এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে প্রায় সব চকলেট কিনে নিয়েছিলাম। পরে নাকি মিতারা গিয়েছিলো সেই দোকানে, দোকানী ভদ্রমহিলা পরবর্তীতে আমাকে বলেছিলো। সাথে এটাও বলেছিলো যে, তোমাদের দলের কাউকে বলিনি তুমি সব কিনে নিয়ে গেছো। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহ্‌ বাচাইছে। নইলে তাদের ভাগ দিতে হতো। কেননা, দশমীর সকালে দিল্লীর প্রায় সকল দোকানপাট বন্ধ। মিতাকে নিয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করে একটা দোকান খোলা পেয়ে সেখান হতে খুচরা যা চকলেট ছিলো মিতা কিনে নিলো। মজার ব্যাপার আমাদের মাথায় এটা ছিলো না যে, এয়ারপোর্ট এর ডিউটি ফ্রি শপ থেকে কিনে নেয়া যাবে। যদিও পরবর্তীতে এয়ারপোর্টের দোকানগুলোতেও ঢুঁ মারা হয়েছিলো; কিন্তু দাম তুলনামূলক অনেক বেশী।

যাই হোক বেলা এগারোটা নাগাদ হোটেল হতে চেক আউট করে রওনা দিলাম দিল্লী এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে। সকল ফর্মালিটিস শেষে দুপুর সোয়া দুইটায় দিল্লী হতে উড়াল দিয়ে বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম কলকাতা এয়ারপোর্ট। এখানে ঘন্টাখানেকের বেশী বিরতি শেষে একটা লক্কর ঝক্কর মার্কা অন্য একটা বিমানে করে এয়ার ইন্ডিয়া আমাদের পৌঁছে দিলো ঢাকা; ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে আটটা, বাংলাদেশের স্থানীয় সময় অনুযায়ী। এরপর পরস্পর হতে বিদায় নিয়ে ছুটলাম বাড়ীর দিকে। ষোল দিনের দীর্ঘ ৮,০০০ কিলোমিটার পথ, ভারতের চারটি প্রদেশ এর আটটি শহর; ঢাকা-কলকাতা-দিল্লী-জম্মু-পাহেলগাঁও-গুলমার্গ-শ্রীনগর-দিল্লী-সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস-মানালি-দিল্লি-কলকাতা-ঢাকা পাড়ি দিয়ে অনেক অনেক দিন পর নিজ বাসা, নিজ বিছানা... হয় নাকো এর তুলনা...তার সাথে ঘরের খানা... জ্বী জাহাপনা 😛।

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ