ভাসিসত উষ্ণ প্রস্রবণ (Vashist Hot Water Springs, Manali) ভ্রমণ

যে কোন কিছুর সমাপ্তিতে একটা সুপ্ত বেদনার রাগিণী থাকে, প্রাপ্তির সাথে সাথে ফেলে আসা স্মৃতি অজানা এক বিরহের প্রচ্ছন্ন মেঘ জমিয়ে তোলে। প্রায় দুই সপ্তাহের ভারত ভ্রমণের শেষ দিন ছিল মানালি’র আশেপাশের কিছু সাইট সিয়িং আর টুকটাক কিছু কেনাকাটা। আগের রাত হতেই প্রচণ্ড হোম সিকনেস গ্রাস করেছিল। এতদিন শুধু কাছের আত্মীয় আর বন্ধুদের কাছে শুনে এসেছিলাম, দেশের জন্য প্রাণ পুড়ে... এবার নিজে টের পেলাম, মাত্র তের দিন! এই সময়েই যেন মনে হল কতদিন ধরে কোন অজানায় পড়ে আছি, কবে ফিরব ঘরে। একই সাথে তেরদিনের আনন্দময় ভ্রমণের স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছিল, আর দু’দিন পর আবার সেই চার দেয়ালের মাঝে বন্দী জীবন, একঘেয়ে নাগরিক কোলাহলে ব্যস্ত জীবন সংগ্রাম... পরস্পর বিপরীতমুখী এই অনুভূতি নিয়ে এদিনের যাত্রা, আমি মোটেও উপভোগ করতে পারি নাই। শুধু মনে হয়েছে, কোন মতে দুটি দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই হল। অথচ আগেরদিন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল, রাতে ঘুমাতে গিয়েছিলাম ভাল মুড নিয়েই, কিন্তু সকাল হতেই মন ভার হয়ে রইল।

যাই হোক, এদিন আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল মানালির “ভাসিসত” নামক একটা উষ্ণ প্রস্রবণ এবং একে ঘিরে গড়ে ওঠা হিন্দু ধর্মীয় তীর্থস্থান। মানালি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বিয়াস নদীর তীরবর্তী পুরাতন মানালির এই এলাকা বিদেশী পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। একই সাথে দেশীয় পর্যটকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তীর্থকেন্দ্র; এখানে রয়েছে দুটি বিখ্যাত মন্দির। সরু পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে জায়গাটা। গাড়ী হতে নেমে দুপাশের নানান দোকান দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে গেলাম সেই মন্দির আর উষ্ণ প্রস্রবণের দিকে। 

এই মন্দিরের নামকরণ হয়েছে ঋষি ভিসাসত এর নামানুসারে; যিনি ছিলেন হিন্দু ধর্মের অন্যতম সাত ঋষি’র একজন। কথিত আছে ঋষি ভিসাসত যখন জানতে পারন যে তার সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে, যার মূল হোতা ছিলেন বিশ্বমিত্র নামক আরেক ঋষি, তিনি তখন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু, বিয়াস নদী উনাকে মরতে দেয় নাই, তখন থেকেই এই নদীর নামকরণ হয়েছে “বিপাশা” যার অর্থ “বাঁধন থেকে মুক্তি”। পরে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে হিন্দিতে বিয়াস নামে পরিচিত হয়েছে। 

সেই ঘটনার পর থেকে ঋষি ভিসাসত নতুন করে জীবনকে উপলব্ধি করা শুরু করেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস মতে এই ভিসাসত মন্দির চার হাজার বছরের পুরানো। এর পাশেই আরেকটি মন্দির আছে, যা মূলত রাম মন্দির। আর এই দুই মন্দির সাথে উষ্ণ প্রস্রবণ, এর সমন্বয়ে এখানে গড়ে উঠেছে তীর্থকেন্দ্র। এখান হতে বিয়াস নদীর অপূর্ব দৃশ্য এখানে আগত পর্যটকদের মুগ্ধ করে। শীত-গ্রীষ্ম সারাবছরই এই উষ্ণ প্রস্রবণ হতে গরম পানি বের হয়ে, সেই পানি দিয়ে এখানকার অধিবাসী, এমন কি আগত পর্যটকের গোসল সহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নেন। 

আরেকটা ব্যাপার না বললেই নয়, এখানকার দোকানগুলোতে এক বিশেষ ধরনের কম্বল বিক্রয় হতে দেখেছি, নাম হল “চিঙ্গু” বা “স্পারু”। বাইরে দালালেরা গিজগিজ করছে, আপনাকে তাদের দোকানে ঢুকানোর জন্য, অনুরোধ করবে কিনতে হবে না, জাস্ট দেখুন একবার। এই কম্বল নাকি গরমে শীতলতা আর শীতে উষ্ণতা দেয়। অনেক দামী কম্বল, চারভাগের একভাগ দামে দিচ্ছে। এর সাথে ফ্রি গিফট হিসেবে আছে কার্পেট, বিছানার চাঁদর থেকে শুরু করে নানান কিসিমের পণ্য। আবার পছন্দ না হলে পণ্য ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে টাকা ফেরতের গ্যারান্টি... :O ভাওতাবাজী কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি? এখানে দেখা যায়। আমরাও দুটো দোকানে ঢুকে দেখলাম, দেখে বের হয়ে এলাম। মনে পড়ল ঢাকা বাণিজ্য মেলা’র এরকম অফারগুলোর কথা। 

 

 

 

আমরা এখানে বেশ কিছুটা সময় কাটালাম; ছবি তোলা হল। এরপর এখান থেকে রওনা হলাম পরবর্তী গন্তব্য "হাড়িম্বা" টেম্পল এর দিকে। 

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ