দ্বীপাঞ্চলের পাণে যাত্রা (কুকরি-মুকরি ভ্রমণ)

দ্বীপাঞ্চলের পাণে যাত্রা (কুকরি-মুকরি ভ্রমণ)

গল্পের ছবিসকল

  • চর কুকরি মুকরি'র বিস্তীর্ন তৃণভূমি আর তার মাঝ দিয়ে বেয়ে চলে খাল
  • যাত্রা পথে চোখে পড়লো ম্যানগ্রোভ বন
  • সমুদ্রের ক্যানেল তথা খালের পথ ধরে চলছে যাত্রীবাহী ট্রলার
  • এই সেই সাপুড়ে আর তার সাপ এর খেলা
  • অপরূপ চর কুকরি মুকরি যাওয়ার পথে সবুজ ধানক্ষেত
দূর্গাপূজার পরপরই কুরবানি ঈদ মিলে প্রায় সপ্তাহব্যাপী লম্বা ছুটি পেয়ে গেলাম। ঈদে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না বিগত প্রায় বছর দশেক হতে চললো। “ভ্রমণ বাংলাদেশ” থেকে এই ঈদের ছুটিতে যাচ্ছে দক্ষিণের সাগরের কোলে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, চর কুকরি ভ্রমণে; বহু বছর পর ঈদে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাওয়ার এই সুযোগটা কাজে লাগাবো কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, যাব কি যাব না? কারণ, আমার ভ্রমণের আগ্রহের ধরণে চরাঞ্চলের উপস্থিতি নেই। কোথায় থাকবো, কি খাবো, কি দেখবো, কিছুই জানি না; শুধু লোকমুখে আর দুয়েকটা লেখায় এই “চর কুকরি-মুকরি’র” নামটা শুনেছি শুধু। তাই দ্বিধা কাজ করে চললো যাত্রার আগে মুহুর্ত পর্যন্ত। আগে থেকে বাল্যবন্ধু মনা’কে বলে রাখা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে কেন জানি যেতে মন চাইছিল না। 
মন চাইছিলো ঈদ-পূজার দীর্ঘ ছুটি বাসায় বসে বসে রসিয়ে রসিয়ে উদযাপন করবো, টিভিতে নানান প্রোগ্রাম দেখবো, আত্মীয়স্বজন এর বাসায় বেড়াবো, কর্মব্যস্ত জীবনে কিছুটা অবসরে মনের রসদ জোগাবো, এমনই ছিল ইচ্ছা। কিন্তু দোটানার অবসান ঘটিয়ে মনস্থির করলাম, নাহ যাই; কিন্তু বন্ধু মনা’কে বারবার ফোনে জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, মনে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলোকে। ও ব্যাটা বাঁকা বাঁকা উত্তর, “চরের মাঝে তাবুতে থাকবো, যা পাওয়া যায় তাই খাবো, ঝোপঝাড়ে প্রকৃতির ডাকে সারা দিবো, যাবি?”। কি যন্ত্রনা! ব্যাটা আমাকে কোথায় উৎসাহিত করবে, দিচ্ছে আগ্রহে পানি ঢেলে। আমি ভ্রমণে গেলে ঘুমানো আর টয়লেট এর ব্যাপারে একটু ঝামেলায় থাকি, এই দুটো আমার মত না হলে যন্ত্রণা হয়; তাই মনের দোটানার দড়িটা আরও লম্বা হল। 
যাই হোক, ঠিক হলো ঈদের পরদিন মনাদের সাথে সদরঘাট থেকে রওনা হবো রাত সাতটার লঞ্চে, মনার সাথে সন্ধ্যার পর চলে যাবো সদরঘাট। সেই হিসেবে ঈদের দিন এবং পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় দু’টো দিন পাওয়া যাবে, ভেবে মনের অন্য ভাবনাগুলোকে সান্ত্বনা দিলাম। কিন্তু ঈদের পরদিন সকালবেলা বন্ধু মনা ফোন দিয়ে জানালো যে আমাদের লঞ্চ মানুষের ভিড়ে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। তাই লঞ্চ দুপুর তিনটায় ছেড়ে যাবে, আমরা অবশ্যই দুপুর দেড়টার মধ্যে যেন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে চলে আসি। আমার এতদিন ধারণা ছিল ঈদে ঢাকা থেকে ঢাকার বাইরে যাওয়ার চাপ থাকে ঈদের আগে আর ঢাকায় ফেরার চাপ থাকে ঈদের পরে। কিন্তু এবার ভোলার উদ্দেশ্যে যাত্রায় আমার এই ধারণা ভুল প্রমানিত হল।
ঈদের দিন রাত পর্যন্ত জানতাম আমাদের লঞ্চ ছাড়বে সন্ধ্যা সাতটায়, এখন শুনি দুপুরে রওনা হতে হবে। আগে থেকে ব্যাগ গুছাই নাই, তাই হুট করে আসা ফোনে দ্রুত ব্যাগ গুছাতে লাগলাম, তবে মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। ভেবেছিলাম ঈদের দুইটা দিন না হলেও কমপক্ষে ঈদের দ্বিতীয় দিন বিকেল পর্যন্ত শুয়ে-বসে কাটাব; কোথায় কি? আবার সেই দ্বিতীয় ভাবনাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো; বার বার মনে হচ্ছিল বাদ দেই এবারের ট্যুর। এমন দোটানাতেই দুপুর একটার দিকে ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম; মনার সাথে রিকশায় উঠলাম সদরঘাটের উদ্দেশ্যে। রিকশায় উঠেও মনা’র খোঁচা, “ভাইবা দেখ, এখনো সময় আছে। না যাইতে চাইলে নাইমা বাসায় যা গিয়া….”। শালার এই ফাউল কথাবার্তা সদরঘাট টার্মিনাল গেটে গিয়েও থামলো না।
দুপুর দুইটা নাগাদ লঞ্চে উঠে গেলাম, লোকে লোকারণ্য পুরো সদরঘাট, আর তার চাইতে কয়েকগুণ বেশী লোক আমাদের লঞ্চে। আগে থেকে দুইটা ডাবল কেবিন এবং একটা সিঙ্গেল কেবিন রিজার্ভ থাকায় আমরা মানুষের স্রোত মাড়িয়ে কোন মতে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লাম আমাদের বিশাল বিশাল কেবিন ত্রয়ে। নামে ডাবল হলেও সাইজে কিন্তু সেইরাম। ছয় ফিট বাই তিন ফিট। কিন্তু লঞ্চতো আর ছাড়ে না, কথা ছিলো দুপুরে ছেড়ে দিবে, মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম। তার মধ্যে কেবিনে আটকে থাকো, কেবিনের বাইরের করিডোরে চাঁদর, বিছানা পেতে সারি সারি মানুষে পুরো ব্লকড চলাচলের জায়গাটুকুও। মন খারাপ করে বসে রইলাম বাক্সবন্দী হয়ে। দীর্ঘ প্রায় চারঘন্টা প্রতীক্ষার পর সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ যাত্রা করলো আমাদের লঞ্চখানি, সদরঘাট থেকে ছেড়ে গেল ভোলার উদ্দেশ্যে, তারই সাথে অবশেষে ভ্রমণ বাংলাদেশের ১৫ জন বন্ধুর সাথে আমার এবারের ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম চর কুকরী-মুকরী’র উদ্দেশ্যে। 
এক ফাঁকে রাতের খাবার সেরে নিলাম, বাইরে আকাশে পূর্ণিমার দুই রাত আগের বিশাল চাঁদ বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছে, মনটা কেমন আকুপাকু করে ছাদের ডেকে গিয়ে মাঝ নদীতে চাঁদের এই অপার্থিব রূপ দেখতে, কিন্তু জানালা দিয়ে মাথা বের করেই দেখি ফ্লোর জুড়ে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা মানুষের সারি। নিমিষেই উবে যায় ছাদে যাওয়ার ইচ্ছা। মন খারাপ করে কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে গান শুনতে থাকি। তখনো কি জানতাম যে কি ভয়ঙ্কর সুন্দর পূর্ণিমা আমার জন্য অপেক্ষা করছে সাগরের বুকে। ফলে সারারাত কেবিনে বন্দী হয়ে আমরা ছুটে চললাম ভোলার উদ্দেশ্যে, ছোট্ট খুপরি কেবিনে কোনমতে দেহ এলিয়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে একসময় সত্যিই ঘুমিয়ে গেলাম।
ভোররাতে আমাদের লঞ্চ ভিড়লো ভোলা খেয়াঘাটে, কিন্তু আকাশে তখনো রাতের কাজল মুছে গিয়ে ঊষার লালিমা লেপা হয়ে ওঠে নাই, তাই অপেক্ষা করলাম লঞ্চেই। এই ফাঁকে জনস্রোতের ঢল অনেকটাই কমে গেল, আর আমরাও একটু নড়াচড়ার সুযোগ পেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তবে পুরো লঞ্চের অবস্থা জঘন্য হয়ে আছে, সাথে গতকাল থেকেই থাকা মাংস পচা গন্ধ চারিদিকে। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, লোকজন কুরবানির মাংস ভর্তি গামলা, ব্যাগ এসব নিয়ে এই লঞ্চে উঠেছে, যেগুলোতে এই দীর্ঘ সময়ে আসলেই পচন ধরার কথা। নাক মুখ চেপে ফ্রেশ হওয়ার নুন্যতম প্রয়োজনটুকু সেরে নিয়ে লঞ্চ হতে নেমে এলাম আমরা। বাইরে এসে ভোরের কোমল বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম, যেন এক নিমিষেই গতকাল দুপুর হতে আজ ভোরবেলা পর্যন্ত ফুসফুসে ঢোকা গন্ধের শেষ কণাটুকু ধাক্কা দিয়ে বের করে নিয়ে আসবো। 
লঞ্চঘাট থেকে আমাদের প্রথম গন্তব্য উকিলপাড়া বাস স্ট্যান্ড, খেয়াঘাট হতে জনপ্রতি ত্রিশ টাকা ভাড়ায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে আমরা চলে আসি উকিলপাড়া বাস স্ট্যান্ড। এখানে সকালের নাস্তা সেরে আমরা টিকেট কাটি চরফ্যাশনের ডাইরেক্ট বাসের। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ বাস ছাড়লেও পথে আমরা আটকা পড়লাম। লালমোহন নামক স্থানে সেদিন ভোর বেলায় বাস-মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টে মোটরসাইকেল আরোহী দুজন মারা যায়। ফলে গ্রামবাসী সড়ক অবরোধ করে বেশ কয়েকটি বাস ভাংচুর করে। ফলে আমাদের বাস দুর্ঘটনাস্থলের কিছুটা আগেই থেমে যায়। এখন বিকল্প উপায়ের খোঁজ করতে মনা আর তাহসিন আমাদের এক জায়গায় জড়ো করে দিয়ে চলে গেল। আমরা সেখানে এক জায়গায় ব্যাগপত্তর সব জড়ো করে রেখে নিজেদের মত সময় কাটাতে লাগলাম। এর মাঝেই কোথা থেকে চলে এলো এক বেদের দল, সাপের খেলা দেখাতে।
আমাদের মত আরও অনেক যাত্রী সেখানে আটকা পড়েছে, তাদের জটলা ঘিরে বেদের দল সাপের খেলা দেখাতে লাগলো। এর মাঝেই চলে এলো সুখবর, একই বাস কোম্পানীর বিপরীত দিক থেকে ছেড়ে আসা বাসও অপর প্রান্তে আটকা পড়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে দুই প্রান্তের বাস যাত্রী বিনিময় করে বাস ঘুরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিবে। আমরা নিজ নিজ ব্যাগপত্তর নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম রিকশাযোগে, অপর পাশে অপেক্ষমান গাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। বেলা সাড়ে এগারটার দিকে আমরা পৌঁছলাম চরফ্যাশন। এবার এখান হতে ম্যাক্সিজাতীয় হিউম্যান হলারে করে যাত্রা করলাম কচ্ছপিয়া ঘাটের উদ্দেশ্যে, সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেলে সেখানেই আমরা স্থানীয় হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয় চলে গেলাম ঘাটে। সেখানে লোকাল ছোট্ট ইঞ্জিনচালিত নৌকোয় করে আমরা রওনা হলাম “চর কুকরী-মুকরী”র উদ্দেশ্যে।
চল্লিশ মিনিটের সমুদ্রের চ্যানেল দিয়ে যাত্রা পথ, সাতার না জানা এই আমি লাইফ জ্যাকেট পড়ে রইলাম পুরো পথটুকুতে। সত্যিই বলতে ভয় পাচ্ছিলাম, কারণ এমনতর যাত্রা এই প্রথম! কচ্ছপিয়া ঘাট হতে কুকরী-মুকরী যাওয়ার পথে অন্য আরেকটি চর অতিক্রম করে গেলাম হাতের ডান দিকে রেখে, যার স্থানীয় নাম “মাইনকার চর” যা আপনি গুগল আর্থে পাবেন “মনিকার চর” নামে। অবশেষে আমাকে ভয় হতে পরিত্রান দিয়ে সেই জলযাত্রা সমাপ্ত করে দুপুর দেড়টার দিকে আমরা পৌছে গেলাম প্রকৃতির লাবণ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা “চর কুকরী-মুকরী। 

ভ্রমণকালঃ ১৭ অক্টোবর, ২০১৩



পরের পর্ব

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ