দুপুর দেড়টা নাগাদ আমরা পৌছাই “চর কুকরী-মুকরী”ঘাট। । সেখানে ঘাট হতে মিনিট দশেক হেঁটে পৌছাই কুকরী-মুকরী বাজারে। বাজারের পাশেই অবস্থিত উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের তিনতলা ভবনে আমাদের আগামী তিনদিনের নিবাস। ভোলা জেলা সদর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে ওলন্দাজ-পর্তুগিজদের অভয়ারণ্য বলে পরিচিত চর কুকরি-মুকরি, যদিও এই ব্যাপারে তেমন কোন তথ্যভিত্তিক প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরের উপকন্ঠে মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর মোহনায় কয়েকশ বছর আগে জেগে ওঠা দ্বীপ, কিন্তু তথ্যগত উপাত্ত বলে গত শতকের একেবারে শুরুর দিকে এই চর জেগে উঠে। এর নামকরণ নিয়ে দুটি ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
একটি হল, শতবর্ষ পূর্বে জার্মান যুবরাজ প্রিন্স ব্রাউন জনমানবহীন এই চরে জাহাজ নিয়ে আসেন শিকারে, তখন তিনি এখানে ছুটোছুটি করতে থাকা কিছু কুকুর আর বিড়াল ছাড়া অন্য কোন প্রাণের অস্তিত্ব দেখতে পান নাই। তখন তিনি একটি নামকরণ করেন যা জার্মান ভাষা থেকে অনুদিত হয়ে বাংলায় কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় ‘কুকরি-মুকরি’ হিসেবে। যদিও এই নামকরণের ইতিহাসটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়ে নাই। অন্য ইতিহাসটি বরং কিছুটা যুক্তিযুক্ত। এক সময় এই চরে শুধু কুকুর আর ইঁদুর যা স্থানীয়দের কাছে মেকুর নামে পরিচিত, ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়তো না। আর সেই কারনেই এর নাম হয়ে যায় কুকরি-মুকরি।
তো চরের নাম যাই হোক, আমাদের দলে ছিলো একই নামের দুজন সদস্য, দুজনেরই ডাক নাম ‘হাসিব’। আমরা সেই ট্যুরে মজা করে তাদের একজনের নাম দিলাম হাসিব-কুকরি আর অন্য জন হাসিব-মুকরি। বিপত্তি ঘটলো, কিছু সময় পর নিজেদের মধ্যে বিভক্তি হয়ে গেল, কোনটা হাসিব-কুকরি আর কোনটা হাসিব-মুকরি তা নিয়ে। পুরোই জগাখিচুরি অবস্থা।
গত শতকের শুরুর দিকে এই চরের জেগে ওঠার ইতিহাস জানা গেলেও, এখানে কখন থেকে জনবসতি গড়ে ওঠে তা জানা গেল না। তবে প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞ থেকে চরাঞ্চলগুলোকে রক্ষার্থে গৃহীত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে এখানে বনায়ন কার্যক্রম শুরু হয় এবং তা পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প হিসেবে রূপলাভ করে। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে চর কুকরি মুকরি এলাকায় প্রশাসনিক উদ্যোগে বনায়নের কাজ শুরু হয়। এই সময় মূলত শ্বাসমূলীয় গাছের চারা রোপণ করে বনায়ন শুরু করা হলেও পরে ক্রমে ক্রমে যুক্ত হয় সুন্দরী, গেওয়া, পশুর প্রভৃতি গাছের চারা রোপণ করা। এছাড়া গোটা এলাকায়ই চোখে পড়ে বিপুলসংখ্যক কেওড়া গাছ।
মূলত বিশাল এলাকায় গড়ে ওঠা এসব গাছ, আশপাশের নারিকেল গাছ, বাঁশ ও বেত বন মিলেই এখানেই তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় একটি ম্যানগ্রোভ শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। বর্তমানে চর কুকরি মুকরির বনে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল, বিভিন্ন প্রজাতির বক, বনমোরগ, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ূর, কোয়েল, গুঁইসাপ, বেজি, কচ্ছপ ও নানা ধরনের সাপ এর দেখা মিলে। আর শীতকালে দেখা মিলে হাজার হাজার অতিথি পাখির যা সত্যি এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি করে।
এদিন আমাদের কোন ভ্রমণ পরিকল্পনা ছিলো না। কিছু খোঁজখবর মনা আর তাহসিন ঢাকা থেকে করে এসেছে, এখন তারা দুজন বাজারে গেল আগামীকালকের ভ্রমণ এর জন্য ইঞ্চিন নৌকার খোঁজ করতে। বাজারে তেমন কোন লোকজন নাই, কেমন ফাঁকা ফাঁকা। এর কারণ হিসেবে জানলাম তখন সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় চলছে, আর তাই মৎস্য নির্ভর জনপদের বাজার ফাঁকা। এদিকে আমরা উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের আশপাশটা ঘুরে দেখলাম।
চমৎকার টলটলে জলের পুকুর দেখে কয়েকজন নেমে পড়লো জলে। আমার মত সাঁতার না জানা মানুষই বা বাকী থাকবে কেন? নেমে পড়লাম জলে, শুদু কি তাই। লাইফ জ্যাকেট বেঁধে পুকুরের এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে সাঁতরে গেলাম, একসময় আমার মতই সাঁতার না জানা আরেকজনাকে এই অধম আমি সাঁতারের ট্রেনিং দেয়া শুরু করলাম। বাজার থেকে মনা ফিরে এসে সেই দৃশ্য দেখে হেসেই খুন। যে নিজেই সাঁতারের “সাঁ”ও জানে না, সে কিনা আরেকজনকে সাঁতার শেখায়! তার মাঝে টিনএইজের শেষে কোন এক ভ্রমণে গিয়ে আমি লাইফ জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায়ও পুকুরে নেমে “বাঁচাও, বাঁচাও” বলে চিৎকার জুড়ে দিয়ে হাঁটু পানিতে যে হাস্যকর পরিস্থিতির তৈরী করেছিলাম সেই গল্পও মনা রসিয়ে রসিয়ে সবাইকে শুনাতে বাকী রাখলো না। ইজ্জত পুরাই পাংচার, আঁচার, পাচার সব করে ছেড়ে দিলো।
সন্ধ্যের পর তাবু খাটানো হল, রুম আর তাবু, অপশন রয়েছে হাতে, যে যেখানে চায় ঘুমাতে পারে। রাতের বেলা পূর্ণিমার আগের রাতের বিশাল এক চাঁদ চরাচর জোছনায় স্নাত করে মোহময় করে রাখলো চারিধার। তার মাঝেও বারবার আমার মনে হচ্ছিল কেন যে ছাই ঈদের আনন্দ মাটি করে বেড়াতে এলাম এই “চর কুকরী-মুকরী”। গ্রামের মাঝে হাঁটা আর পূর্ণিমা, এত বাংলাদেশের যে কোন গ্রামেই পাওয়া যাবে। 😜
পরদিন সকালবেলা ঘুম ভেঙ্গে উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের তিনতলার ছাঁদের পেছন অংশে গিয়ে দেখি পেছনে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্ষেত, ধান এর চারা রোপন করা হয়েছে। চোখ ধাঁধানো সবুজে দেহমনে অদ্ভুত প্রশান্তি খেলে গেল। অনেকটা সময় সেখানে বসে বসে প্রকৃতির রূপসুধা পাণ করে নিলাম, ব্যস্ত এই যান্ত্রিক শহুরে জীবনে এই সুযোগ মিলবে কোথায়?
সকালের নাস্তা শেষে সবাই তৈরী হয়ে নিলাম আজকের যাত্রার জন্য। আজকের প্রথম গন্তব্য ঢালচর-কালীর চর, সেখান থেকে তারুয়া সৈকত হয়ে শেষ গন্তব্য বঙ্গোপসাগরের গহীনের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা “সোনার চর”। আমরা তৈরী হয়ে বাজারের আগে খালের ধারে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমাদের ইঞ্চিন নৌকার, কিন্তু তার আর খবর নেই। এদিকে সময় গড়িয়ে যায়। বসে থেকে থেকে বিরক্তি ধরে গেল।
এরই মাঝে ওসমান ভাই আর বেলাল মিলে গেল ডাবের খোঁজে। হুট করেই ভূত চেপেছে ডাবের পানি পাণ করবে সবাই। সারাগ্রাম ঘুরে এক লোককে নিয়ে আসলো, তার গাছের ডাব পেড়ে নিয়ে এসেছে, সে নাকি টাকাই নিতে চাইছে না। তো সবাই ডাব খাওয়া হয়ে গেলে লোকটিকে প্রতিটি ডাব বিশ টাকা হিসেবে যতটি ডাব ছিলো তার সমপরিমাণ টাকা দেয়া হলে সে ঐ টাকা নিতে রাজী হলো না। খুশী হওয়ার কিছু নেই, তিনি দাবী করছে চল্লিশ টাকা প্রতি পিস!!! কিছুক্ষণ দরদাম করেও তাকে রাজী করানো গেল না, শেষে চল্লিশ টাকা দরেই তাকে টাকা পরিশোধ করে দেয়া হলো। এদিকে ওসমান ভাই আর বেলাল এর অবস্থা দেখার মত, বেচারা দুজন পুরাই বোকা হয়ে গেছে পুরো ঘটনায়। আর এসব ঘটনার ঘনঘটার দফারফা করে বহুল প্রতীক্ষিত আমাদের চার ঘোড়া (হর্স পাওয়ার) ইঞ্জিনের মাছ ধরার ট্রলারকে আসতে দেখা গেল কুকরি-মুকরি’র সরু ক্যানেল ধরে।