ভয়াল সৌন্দর্যের দ্বীপ - চর কুকরী-মুকরী

ভয়াল সৌন্দর্যের দ্বীপ - চর কুকরী-মুকরী
দৃষ্টির সীমানার পুরোটা ফোকাস জুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ। দৃষ্টিকে সম্মোহন করে হাতছানি দিতে থাকে টুকরো টুকরো নিবিড় বনভূমি। শিল্পী তপুর গানের মত বলতে হয়, “একপাশে বঙ্গোপসাগর তোমার, অন্যপাশে বনভূমি"। উত্তাল ঢেউ, বৈরী বাতাস আর জলোচ্ছ্বাসের গর্জন যখন আপনার কর্ণকুহর হয়ে মস্তিস্কে পৌঁছে উদ্বেল করবে আপনার ভাবনার জগতকে, ঠিক তখনই অন্য পাশের সবুজ দ্বীপ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি আপনাকে দিবে নিবিড় ভালোলাগার এক চিরসবুজ প্রশান্তি। আর এই অন্য পাশের সবুজ দ্বীপ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি হল চর কুকরি মুকরি।
ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অনেকটা সাগরের কোল ঘেষে মেঘনা ও তেতুঁলিয়া নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা এই চর কুকরি মুকরিতেই রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। কথিত আছে যে একসময় এই চরে শুধুমাত্র কুকুর আর ইঁদুর (স্থানীয়দের কাছে যা মেকুর নামে পরিচিত) ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়তো না। আর তাই এই চরের নামকরণ হয় চর কুকরি মুকরি। 
বঙ্গোপাসাগরের কোল ঘেষে মেঘনা নদীর মোহনায় কুকরি-মুকরির অবস্থান। চারিদিকে জলরাশিদ্বারা বেষ্টিত প্রমত্তা মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে পলি জমতে জমতে এ দ্বীপটির জন্ম। সাগরের কোল ঘেষে জন্ম নেওয়ায় কুকরি-মুকরিকে অনেকে স্বপ্নের দ্বীপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, প্রায় ৮’শ বছরের পুরনো এই স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি-মুকরি বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চল তথা সর্বাঞ্চলের কাছে অতি পরিচিত নাম। 
স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি-মুকরির ইতিহাস বেশ প্রচীন। ৭’শ বছর আগে এখানে ও মনপুরায় পূর্তগীজ জলদস্যূদের আস্তানা ছিল। কিন্তু কোন এক সময় এই চরটি পানির তলে হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯১২ সালে এই চরটি আবার জেগে ওঠে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার কুকুরি-মুকুরি চরে বন সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে বনায়ন করার নিদের্শ দিলে ১৯৭৩ সনে বনায়ন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৯ সালের ১৪ মে বন বিভাগের কাছে এক (সর্বশেষ সংশোধিত) প্রজ্ঞাপনে লিখিত নির্দেশনা আসে, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জান-মাল রক্ষায় ভোলায় কমপক্ষে ৩ লাখ ৬০ হাজার একর জমিতে সংরক্ষিত শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) বনায়ন করতে হবে। এ সময় মূলত শ্বাসমূলীয় গাছের চারা রোপণ করে বনায়ন শুরু করা হলেও পরে ক্রমে ক্রমে যুক্ত হয় সুন্দরী, গেওয়া, পশুর প্রভৃতি গাছের চারা রোপণ। এ ছাড়া গোটা এলাকা জুড়েই চোখে পড়ে বিপুল সংখ্যক কেওড়া গাছ। 
মূলত বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা এই সব গাছ আর আশপাশের নারিকেল গাছ, বাঁশ ও বেত বন মিলেই এখানে তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় একটি ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। বন বিভাগ ও বিভিন্ন সূত্র জানায়, ভাঙা গড়ার আবর্তে পড়ে বর্তমান কুকুরি-মুকুরি চরে বনায়নের পরিমাণ ৮৫৬৫ হেক্টর। যার মধ্যে বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম ২১৭ হেক্টর। বসতি ও কৃষি আবাদ আছে প্রায় ৪ হাজার ৮১০ হেক্টরে। চরের মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা ও কৃষিকাজ। 
চর কুকরি মুকরির বনে যেসব প্রাণী দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল, বন্য মহিষ-গরু, বন-বিড়াল, বন মোরগ, প্রভৃতি। আর পাখি ও সরিসৃপ হিসেবে এই বনের অধিবাসীদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বক, বন মোরগ, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ূর, কোয়েল, গুইসাঁপ, বেজি, কচ্ছপ, কুকুরি বনের ও নানা ধরনের সাপ। দ্বীপ কুকরি-মুকরি শীতকালের চিত্র ভিন্ন ধরনের। সুদ্দর সাইরেরিয়া থেকে ছুটে আসা অতিথি পাখিদের আগমনে চরাঞ্চলগুলো যেন নতুন রূপ ধারন করে। বিশেষজ্ঞদের মতে শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে যার মধ্যে সিংহ ভাগই ভোলায় অবস্থান করে। 
তখন স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি-মুকরির চরে অতিথি পাখিদের অভয়ারন্যে পরিনত হয়। এছাড়া এখানকার সমুদ্র সৈকতটিও বেশ পরিচ্ছন্ন ও নিরিবিলি। দেশের অন্যান্য পর্যটক কেন্দ্রগুলোর তুলনায় কুকরি-মুকরির চিত্র কিছুটা ভিন্ন ধরনের। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির বিশাল ক্যানভাস স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি-মুকরিকে সাজিয়েছে সাজের সমারোহে। যেখানে জীবিত গাছের সংখ্যা ৯ কোটিরও বেশি। 
চর কুকরি মুকরির ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। খালটির নাম ভাড়ানি খাল। মেঘনার বিশাল বুক থেকে বয়ে গিয়ে খালটি পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। এখানকার ধু-ধু বালিয়াড়ির ওপর দাঁড়ালে সাগরের শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাবে না। একটু সামনে এগোলেই ঢাল চর। এর পরই বঙ্গোপসাগর। এখানে উত্তাল ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখলেই মনে পড়ে যাবে কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের কথা। স্থানীয় মানুষ এ স্পটটিকে বালুর ধুম নামে ডাকে। 
তবে কুকরি মুকরির প্রধান আকর্ষণ সাগরপাড়। এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত কিংবা সূর্য ডোবার দৃশ্য ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করবে। চর কুকরি মুকরির এ সৌন্দর্য খুব টানে পর্যটকদের। চর কুকরি মুকরি তে যেতে চাইলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রথম জলপথে কোনো লঞ্চ বা জাহাজে চড়ে প্রথমে ভোলায় আসতে হবে। তারপর ভোলা লঞ্চঘাট থেকে চর ফ্যাশনের বাসে চড়ে আসতে হবে চর আইচাতে। আর এখান থেকে চর ফ্যাশন এর চর কচ্ছপিয়া উপজেলা ট্রলার ঘাট হয়ে আবারও ইঞ্জিন নৌকায় বেশ খানিকটা জলপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো যাবে চর কুকরি মুকরিতে। 

ছবিতে অপূর্ব চর কুকরি মুকরি

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ