প্রথমে যখন দূর থেকে দিগন্তরেখায় কালো রেখার মত তারুয়া দ্বীপের গাছগুলো দৃষ্টি সীমানায় এলো তখনও পেছনে ঢালচর বা কালীরচর দৃষ্টি সীমানা হতে হারিয়ে যায় নাই। তন্ময় হয়ে আমরা পনের জনের ভ্রমণ পাগল মানুষ চেয়ে আছি সেই হাতছানি দেয়া অপার সৌন্দর্যের সমুদ্রতটের পাণে। ঢাল চর থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেকের মত সময় ইঞ্চিন নৌকায় সমুদ্রপথ মাড়িয়ে আমরা পৌঁছলাম ভোলার চর ফ্যাশন এর আলোচিত সম্ভাবনাময় পর্যটন সৈকত তারুয়ায়।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকের কথা, ভ্রমণ বাংলাদেশ থেকে আমরা পনের জনের দল গিয়েছিলাম চর কুকরি মুকরি ভ্রমণে। সেই ভ্রমণের অংশ ছিল সদ্য আলোচিত সৈকতের তারুয়া দ্বীপ ভ্রমণে। প্রথম দিন রাতের বেলা স্থানীয়দের সাথে কথা বলে ১৬ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করা হয় পরের দিন ঢালচর, তারুয়া দ্বীপ আর সোনার চর ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। গত অক্টোবরে সেই ভ্রমণ নিয়ে লিখেছিলাম “চার চর আর তিন সৈকত” নামক পোস্ট। বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত নিয়ে লেখার নিমিত্তে আমার ভ্রমণ করা সৈকতগুলো নিয়ে নতুন করে পোস্ট করার ধারাবাহিকতায় আজ থাকছে তারুয়া সৈকতের গল্প।
দুই বছর আগের সেই ভ্রমণের সময় আমি খুব ভয়ে ছিলাম পানিপথে ভ্রমণ নিয়ে, কারণ দুঃখজনক হলেও সত্য আমি সাঁতার জানি না। সারাটা ভ্রমণের সময় ভয়ে তটস্থ ছিলাম, এযে নদীপথও নয়... সরাসরি সমুদ্র!!! লাইফ জ্যাকেট সারাক্ষণ গাঁয়ে বাঁধা ছিল। সবার জন্য লাইফ জ্যাকেট থাকা সত্ত্বেও আমি আর দুএকজন ছাড়া বাকী কেউ লাইফ জ্যাকেটের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় নাই। আমাদের ভ্রমণের সময়টায় সমুদ্র অসম্ভব শান্ত ছিল, একটা কোন বড় ঢেউয়ের মুখোমুখি হতে হয় নাই আমাদের। কিন্তু সবসময় এমনটা হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। তাই সবার উচিত পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করা এই ধরণের ভ্রমণের ক্ষেত্রে।
যাই হোক ঢালচর ঘুরে আমরা যখন তারুয়া দ্বীপে পৌঁছলাম তখন সূর্য মধ্যাকাশে। প্রায় কোমর পানিতে সবাইকে জামা কাপড় গুটিয়ে নেমে যেতে হল, কারণ পানির তলদেশের বালি আমাদের নৌযানকে আর এগুতে দিচ্ছিল না। ঝপাঝপ সবাই নেমে পড়লাম পানিতে গা ভিজিয়ে, এগিয়ে গেলাম এই চমৎকার বালুকাবেলায় কিছু সময়ের জন্য আনন্দ অবগাহনে। নিশ্চুপ, কোলাহল মুক্ত, ফাঁকা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সৈকতের দিকে চেয়ে থাকলে হৃদয়ের গোপনে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি পাওয়া যায়। দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত নীরবে একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন আপনাকে বরণ করে নিতে। তবে, এখন যেভাবে এই জায়গাগুলোতে লোক সমাগম বাড়ছে, জানিনা এখন সেই রূপ দেখা যাবে কি না? ইদানীং শুনছি সেই জায়গাগুলোতে হোটেল মোটেল করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। পর্যটনের বিকাশের লক্ষ্যে!
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার অন্তর্গত সমুদ্র উপকুলে এই চরটি গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে বনবিভাগের উপকূলীয় কৃত্রিম বনায়ন কার্যক্রমের আওতায় ঢালচর, চর কুকরি মুকরি, মাইনক্যার চর সহ এই তারুয়া দ্বীপের বনায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এই দ্বীপের কৃত্রিম বনে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছের মাঝে রয়েছে হরিণ, বন মোরগ, বিভিন্ন ধরণের সাপ সহ অসংখ্য পাখীর সমাবেশ। বিশেষ করে শীতকালে এখানে প্রচুর পাখীর দেখা মেলে। ইদানীং পাখী নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কাছে ভোলার চর ফ্যাশনের বিভিন্ন দ্বীপগুলো খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উল্লেখ থাকে যে, ঢালচর, চর কুকরি মুকরি সহ তারুয়া দ্বীপে যে সকল পশু দেখা যায় সেগুলোর বেশীর ভাগই বন বিভাগ কর্তৃক অবমুক্ত করা হয়েছিল।
আমরা সকালবেলা নাস্তা করে বের হয়েছিলাম, সাথে ছিল হালকা বিস্কুট আর পানি কয়েক বোতল। কিন্তু মাথার উপর সূর্য নিয়ে এতোটা সময় পার করে দিয়ে এক সময় সেই সম্বলও ফুরিয়ে গেল। আসলে, আমরা যখন চর কুকরি মুকরি থেকে রওনা হই, আমাদের কোন ধারণা ছিল না কত সময় লাগতে পারে। একদিনে ঢালচর, তারুয়া আর সোনার চর দেখে আমরা সেদিন কুকরি মুকরি ফিরেছিলাম রাত নয়টায়। অবশ্য রাতের বেলা আকাশে পূর্ণিমার ঘোর লাগানো অদ্ভুত গোলাপি-হলদে বিশাল থালার ন্যায় চাঁদ আর আমাদের হেঁড়ে গলার গানের ফাঁকে ভুলেই গিয়েছিলাম সমুদ্রের বুকে আমাদের নৌকা ছাড়া আর কোন নৌকা নেই। কেননা তখন ইলিশ প্রজননের মৌসুম হওয়াতে সকল ধরণের মাছ ধরার নৌকা চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। তবে, আমার জীবনের স্মরণীয় ভ্রমণ ছিল সেদিনকার সেই ভ্রমণ।
জেলা শহর ভোলা থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই তারুয়া দ্বীপ। প্রায় চল্লিশ বছর আগে জেগে ওঠার পর থেকে সেই দ্বীপ মাছ ধরার জেলেদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লোকমুখে শোনা যায়, সেখানে এক প্রকার সামুদ্রিক মাছ প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়ত যেগুলোর আঞ্চলিক নাম ছিল তারুয়া, সেই থেকে নাকি এই দ্বীপের নাম হয়েছে তারুয়া দ্বীপ। সত্য-মিথ্যা আমার জানা নেই, বা যাচাই করার প্রয়োজন মনে করি নাই। ভোলা শহরের চর ফ্যাশন থেকে কচ্ছপিয়া ঘাট পর্যন্ত যাওয়ার জন্য বাস, লেগুনা বিভিন্ন সড়ক যান রয়েছে। কচ্ছপিয়া ঘাট পৌঁছে সেখান থেকে ইঞ্চিন নৌকা ভাড়া করে আপনি সহজে চলে যেতে পারেন কুকরি মুকরি অথবা ঢালচর হয়ে তারুয়া দ্বীপ। চাইলে সরাসরি তারুয়া দ্বীপ।
তবে যে হারে পর্যটকের সংখ্যা এবং নানান পর্যটন বিকাশের কার্যক্রম (ধান্দাবাজি ছাড়া আর কিছু কি হবে? :( ) চলছে, খুব শীঘ্রই হয়ত সেই নীরব কোলাহল মুক্ত তারুয়া দ্বীপ ঠাই পাবে ইতিহাসের পাতায়, পরিণত হবে আরেক সেন্টমার্টিন! প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য লালন পালন করা কবে যে আমরা শিখবো?
ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়ায় ছবিগুলো সব মোবাইল হতে তোলা, তাই রেজুলেশন খুব খারাপ এসেছিল :(বিশ্বাস না হলে নিজ চোখে দেখেন...
তো, সেই তারুয়া দ্বীপের সমুদ্র সৈকতে ঘণ্টা খানেক আনন্দময় সময় কাটিয়ে শেষ দুপুরের বিষণ্ণ সময়ে আমরা রওনা দেই আমাদের শেষ গন্তব্য সোনার চরের উদ্দেশ্যে। আর পেছনে রেখে যাই আমাদের স্মৃতির পদচিহ্ন এই মায়াময় সমুদ্র সৈকতে।
গল্পের ছবিসকল
ঢালচর হতে তারুয়া সৈকতের পথে যাত্রা
মাছ ধরায় নিষিদ্ধ থাকায় সমুদ্র ক্যানেলে একমাত্র নৌকা হতে দেখা শূন্য চরাচর
ঐ দূরে দেখা যাচ্ছে তারুয়া
দূরেই থামিয়ে দিতে হল আমাদের নৌকা, হাটুজলে নেমে পড়লাম সবাই
হাটুজল মাড়িয়ে তারুয়া সৈকতে পা রাখার ক্ষণ
ম্যানগ্রোভ বন নিয়ে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা তারুয়া সৈকত
দূর হতে দেখা যায় আমাদের একজনকে
নিজেদের মত করে ঘুরে বেড়ানো তারুয়া সৈকত জুড়ে
চলছে দাপাদাপি তারুয়া সৈকতের পথ ধরে
কেউ কেউ অলস ভঙ্গীতে সাগরের জলে পা ছুঁইয়ে আনমনে চলছে