আমাদের প্ল্যান ছিল সকাল আটটার মধ্যেই আমরা সিলেট শহর থেকে বের হয়ে যাবো। গতকাল রাতে লালাখাল, বিছানাকান্দি ঘুরে এসে (সেই লেখা পড়ুনঃ বিছানাকান্দি'র বিছানায় )রাতে উঠেছিলাম আবাসিক হোটেল এশিয়ায়। এসিরুমে ক্লান্ত দেহে সেইরকম একটা ঘুম দিয়ে সকালে ফ্রেশ সবাই। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো ট্রান্সপোর্ট নিয়ে। সিলেট থেকে কোন বাস বা ট্রেন চলছে না, ট্রেন ষ্টেশনে গিয়ে আটকে পড়লাম। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ, সবাই দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। আমি আর রুমি গিয়ে কয়েকটা মাইক্রোবাস ড্রাইভারের সাথে কথা বললাম, আমরা যাবো মাধবকুণ্ড। কিন্তু উনারা সুযোগের সদব্যাবহার করে দ্বিগুণ ভাড়া হাঁকলেন। আমরা মিইয়ে গেলাম তাদের ভাড়া শুনে। কিন্তু আর কোন উপায়ওতো দেখি না...।
গত বছর ৫ই অক্টোবর সকালবেলা আমরা সিলেট এসে পৌঁছই, যার পরেরদিন ছিল সিলেটে তৎকালীন বিরোধী দলের মহাসমাবেশ। আমাদের ট্যুর প্ল্যান অনেক আগে করা ছিল বিঁধায় আমরা আর প্ল্যান চেঞ্জ করি নাই। আমাদের প্ল্যান ছিল ৬ তারিখ সকাল বেলা আমরা সিলেট শহর ছেড়ে বেড়িয়ে যাবো, যাতে করে মহাসমাবেশের জ্যাম বা কোন ঝামেলায় আমাদের পড়তে না হয়। কিন্তু এখন কি মুশকিল, গাড়ীতো পাচ্ছি না। সরকারীভাবে বিকেল পর্যন্ত সকল আন্তঃজেলা পরিবহণ অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দিছে। তখন মনে হল দূরে দাঁড়ানো সিএনজিগুলোর কথা। ঐদিকে গিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। এক ড্রাইভার বলে, ‘ঝর্না দেইখা কি করবেন? এর চেয়ে চলেন মাজারগুলা ঘুরায়া আনি...’। আরেকজনতো মহা আবহাওয়াবিদ, সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল, সে বলে, ‘ঐখানে কি এহন মানুষ জাইতে পারবো? ঠাণ্ডায় জইমা বরফ হইয়া যাইব’! বুঝেন অবস্থা। অবশেষে কয়েকজনের সাথে কথা বলে এক সিএনজি ড্রাইভার এক হাজার টাকায় রাজী হল মাধবকুণ্ড যেতে। শুরু হল আমাদের সিলেট ত্যাগের যাত্রা।
কিন্তু পথে জায়গায় জায়গায় জটলা, গাড়ীর জ্যাম। দলে দলে লোক গাড়ী করে ছুটছে সিলেট অভিমুখে, আর আমরা স্রোতের বিপরীতে সেই জটলা হতে পালাচ্ছি। এভাবে ভালই চলছিল, পথে এক জায়গায় টহল পুলিশ গাড়ী থামানোর ইশারা করল। আমাদের ড্রাইভার গাড়ী সাইড করার অভিনয় করে একটু সামনে নিয়ে হঠাৎ দিল ভোঁ এক টান! আমরা চেচিয়ে উঠলাম, সে গাড়ী থামালো না কেন? তার উত্তর তার গাড়ীর কাগজে সমস্যা আছে, সে সিলেট শহরের বাইরে যেতে পারবে না... তাই সেখানে থামায় নাই। কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘটল ঘটনা, সেই ট্রাফিক পুলিশ দলের ইন্সপেক্টর সেখান থেকে আমাদের সিএনজি গাড়ীর পেছনে পেছনে মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে এসে পাকড়াও করলেন আমাদের গাড়িকে। এবার ঠ্যালা সামলাও, প্রায় মিনিট পনের ড্রাইভার আর পুলিশে দেনদরবার শেষে ২০০ টাকার বিনিময়ে আমাদের ড্রাইভার রেহাই পেল। এতশত ঝামেলা পেরিয়ে বেলা এগারটা নাগাদ আমরা মাধবকুণ্ড এসে পৌঁছলাম।
মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক, বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের অন্তর্গত মৌলভীবাজার জ়েলার বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলিতে অবস্থিত একটি ইকোপার্ক। এই ইকোপার্কের অন্যতম আকর্ষণ হলো মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, পরিকুণ্ড জলপ্রপাত, শ্রী শ্রী মাধবেশ্বরের তীর্থস্থান, এবং চা বাগান। মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী থানা বড়লেখার ৮ নম্বর দক্ষিণভাগ ইউনিয়নের অধীন গৌরনগর মৌজার অন্তর্গত পাথারিয়া পাহাড়ের গায়ে এই মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের স্রোতধারা বহমান এবং এই পাহাড় থেকে পতনশীল। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতকে ঘিরেই এই ইকোপার্কটি গড়ে ওঠে। এই পাথারিয়া পাহাড়, সিলেট সদর থেকে ৭২ কিলোমিটার, মৌলভীবাজার জেলা থেকে ৭০ কিলোমিটার, কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে ৩২ কিলোমিটার এবং কাঁঠালতলী থেকে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত হিসেবে সমধিক পরিচিত। পাথারিয়া পাহাড় (পূর্বনাম: আদম আইল পাহাড়) কঠিন পাথরে গঠিত; এই পাহাড়ের উপর দিয়ে গঙ্গামারা ছড়া বহমান। এই ছড়া মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ে হয়েছে মাধবছড়া। অর্থাৎ গঙ্গামারা ছড়া হয়ে বয়ে আসা জলধারা [১২ অক্টোবর ১৯৯৯-এর হিসাবমতে] প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু থেকে নিচে পড়ে মাধবছড়া হয়ে প্রবহমান। সাধারণত একটি মূল ধারায় পানি সব সময়ই পড়তে থাকে, বর্ষাকাল এলে মূল ধারার পাশেই আরেকটা ছোট ধারা তৈরি হয় এবং ভরা বর্ষায় দুটো ধারাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পানির তীব্র তোড়ে। জলের এই বিপুল ধারা পড়তে পড়তে নিচে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট কুণ্ডের। এই মাধবছড়ার পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হতে হতে গিয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওরে। কুণ্ডের ডানপাশে পাথরের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে একটি গুহার, যার স্থানীয় নাম কাব। এই কাব দেখতে অনেকটা চালাঘরের মতো। মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে স্নানর্থীরা কাবের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজা কাপড় পরিবর্তন করে থাকেন।
আমরা যখন মাধবকুণ্ড ঝর্না’র কাছে যাই তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, আর ঝর্নার রূপ কিন্তু বৃষ্টিতেই বেশী সুন্দর, কেননা পানির প্রবাহ তখন বেশী থাকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের ব্যাগেজ, এগুলো কোথায় রাখি? পরে অনেক খুঁজে পেতে দেখলাম সেখানে স্থানীয় ইউএনও অফিসের পক্ষ থেকে কিছু ফটোগ্রাফার কাজ করছে যারা টাকার বিনিময়ে দর্শনার্থীদের ছবি তুলে দেয়। আমাদের সাথে ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও একটা বছর বিশেকের ছেলেকে নিলাম ছবি তোলার জন্য, কিন্তু শর্ত একটাই আমাদের ব্যাগগুলো রাখার একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। সে রাজী হল, মাধবকুণ্ডে ঢোকার পর ঝর্নায় যাওয়ার পথে হাতের ডানদিকে যে মন্দিরটি পরে, সেখানকার পূজারী’র নিকট আমাদের ব্যাগ জমা রেখে আমরা গেলাম ঝর্ণায়। কিন্তু মাধবকুণ্ড ঝর্ণায় তখন পানির সেকি ঢল! কেউ একেবার ঝর্ণার নীচে যেতে পারছে না, সবাই ঝর্ণার পানি যে পথে প্রবাহিত হয়ে বেরিয়ে আসে সেই পথে জলকেলি করে দুধের সাধ ঘোলে মিটাচ্ছিল। আমরা কিছু ছবি তুলে সেই গাইড ছেলেকে নিয়ে গেলাম পরিকুণ্ড ঝর্না দেখতে।
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ছাড়াও এই ইকোপার্কে রয়েছে আরেকটি জলপ্রপাত, যা মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত থেকে অনতিদূরে অবস্থিত। শিবমন্দির-এর বিপরীত দিকের ছড়া ধরে গেলে এই জলপ্রপাতের দেখা পাওয়া যায়। এই জলপ্রপাতটি পরীকুণ্ড জলপ্রপাত নামে পরিচিত। তবে এই জলপ্রপাতটি কেবল বর্ষাকালেই প্রাণ ফিরে পায়। মাধবকুণ্ড ঝর্ণায় ঢোকার মুখে মন্দিরের ঠিক উল্টা পাশ দিয়ে যে ঝিরিপথটি গেছে সেই পথ ধরে মিনিট দশেক হাঁটলে পরে পাওয়া গেল পরিকুণ্ড ঝর্না। আমাদের সাথে আরও দুইতিনজন এল আমাদেরকে আসতে দেখে। সবাই মিলে যখন পরিকুণ্ড ঝর্ণার নীচে হিমশীতল জলে ভিজে প্রকৃতির সৃষ্টির স্বাদ আস্বাদনে মশগুল, আমাদের ফটোগ্রাফার গাইড তখন ক্লিকবাজী’তে মশগুল। কারণ যত ক্লিক তত তার ইনকাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক সেখানে ভেজার পর আমরা বের হয়ে এলাম পরিকুণ্ড’র ঝিরিপথ থেকে। ততক্ষণে বৃষ্টিও কমে এসেছে, বেলা মধ্য দুপুর। এবার আমাদের ফেরার পালা, পরেরদিন চারজনেরই অফিস আছে। তাই ঝটপট রওনা হলাম মৌলভীবাজার বাসস্ট্যান্ড এর দিকে, পথে গরম চা দিয়ে শরীর চাঙ্গা করে নিলাম।
বেলা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমরা যখন বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম, ততক্ষণে দিনের শেষ বাসটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। কি করা যায়? আমরা একবার এনা পরিবহণ এর কাউণ্টার এ যাই একবার শ্যামলী পরিবহণের কাউণ্টারে। পরে আমাদের ইমারজেন্সি বুঝতে পেরে শ্যামলী পরিবহণের কাউণ্টার ইনচার্জ হজ্জযাত্রী পরিবহণের তাদের এসি গাড়ীতে আমাদের চারটা সিট বুক করে দিলেন। আমরা তখন দুপুরের ভোজ সেরে নিয়ে বেলা সাড়ে ছয়টার পরে গাড়ী আসলে রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। পথে নানা ঝক্কি ঝামেলা, জ্যাম পেরিয়ে রাত আড়াইটায় আমরা পৌঁছই মহাখালী। শেষে এক কলিগের বাসায় উঠলাম, কারণ চারজনের অফিসই গুলশান-মহাখালী এলাকায়। সকালে যেন ঘুম থেকে উঠেই চোঁ দৌড় দিতে পারি অফিস অভিমুখে।
তো এই বর্ষায় আসছে ঈদ। এই ঈদে বেড়িয়ে আসতে পারেন মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক, সাথে আছে চা বাগান আর মাধবকুণ্ড ও পরিকুণ্ড ঝর্নাতো রয়েছেই। তো..... যাচ্ছেন নাকি এই ঈদে?