ভ্রমণ বাংলাদেশের উদ্যোগে গত ১লা মে’র ছুটিকে সামনে রেখে ১ - ৩ মে সিলেটের জাফলং, জৈন্তাপুর রিসোর্ট, বিছানাকান্দি, লালাখাল, রাতারগুল – এই স্পট নিয়ে তিনদিনের একটা ট্র্যাভেল ইভেন্ট দেয়া হল। কিন্তু ইভেন্ট দেয়ার পর থেকে কনফিউশন ছিল বিছানাকান্দিতে পানি থাকবে কি না তা নিয়ে। তার সাথে সবকিছু সুন্দরভাবে এরেঞ্জমেন্ট এর ব্যবস্থা করা দরকার। তাই ৩০ জনের দলের জন্য প্রি-এরেঞ্জমেণ্ট করতে আমি আর টুটুল ভাই দুই দিন আগে ২৯ তারিখ রাতের গাড়ীতে সিলেটের উদ্দেশ্যে ঢাকা হতে রওনা হই। গত বছরই আমি আমার তিন কলিগকে নিয়ে বিছানাকান্দি ঘুরে গেছি, আর স্থলপথে বিছানাকান্দি পর্যন্ত রাস্তা খুবই খারাপ, খুবই বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তাই আমি শুরু থেকে এই ইভেন্টের পক্ষে ছিলাম না।
রাতের বাসে আরামবাগ থেকে রওনা হয়ে সারারাত বাস জার্নি করে আমরা দুজন যখন ৩০ তারিখ ভোর বেলা সিলেট পৌঁছই তখন তুমুল বৃষ্টি। সকালের নাস্তা করে আমাদের প্রথম কাজ ছিলো ট্যুর এর দ্বিতীয় দিন এর জন্য হোটেল এর খোঁজ করা। বড় হোটেল খুঁজতে খুঁজতে এক বাজার এলাকার ভিতর দিয়ে পুরোনো একটা হোটেল খুঁজে বের করা হলো; অনেকটা ভেতরে। টুটুল ভাই রিসেপশনে কথা বলে পুরো দলের জন্য রুম বুক করে নেয়ার সময় আমি গেলাম হোটেলের কর্মচারীর সাথে রুম দেখতে। রুম নোংরা, চাঁদর উঠাতে দেখি ছারপোকা গিজগিজ করছে... ইয়াক।
তিনতলা থেকেই টুটুল ভাইকে ফোন দিলাম, "এডভান্স কইরা ফালাইছেন?"। টুটূল ভাই জানালো না, টাকা দিচ্ছে। আমি দ্রুত বললাম টাকা দিয়েন না, আমি আসতেছি। টুটুল ভাইকে নীচে নেমে বুঝিয়ে বললাম রুম পছন্দ হয় নাই, নোংরা আর ছারপোকা ভরা বিছানার নীচে। সেখান থেকে বের হয়ে একটু খোঁজ খবর করতে করতে একসময় পৌঁছলাম জেল রোডের পুরাতন ঐতিহ্যবাহী "হোটেল অনুরাগ" এ। হোটেলের চেহারা দেখে মনে হল মন্দ না, বাজেট হোটেল হিসেবে ঠিক আছে। কথা বার্তা বলে আমরা সেই হোটেলে একটা রুম নিয়ে ব্যাগপত্তর রাখলাম আর তারই সাথে ২ তারিখ রাতে আমাদের দলের ৩০ জনের জন্য রুম বুকিং করে ফেললাম।
রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা ২ জন বের হলাম এবার ৩ তারিখের জন্য তিনটা হিউম্যান হলার ভাড়া করার জন্য যা খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান হয়ে রাতারগুল নিয়ে যাবে আমাদের পুরো দলকে। আমাদের পুরো দল ঢাকায় ফিরবো ৩ তারিখ দুপুর তিনটার ট্রেনে, ঢাকা পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দশটার উপরে বাজবে। তাই এরপর সিলেট শহরে আমাদের আর কাজ বাকী ছিলো ফেরার দিন সন্ধ্যার জন্য ভালো একটা স্নাক্স আইটেমের খোঁজ করা। একটু খোঁজ করতেই পাওয়া গেল একটা ভালো কনফেকশনারি, যেখানে এডভান্স পেমেন্ট করে ৩ তারিখের জন্য চিকেন বার্গার অর্ডার করে দিলাম। যদিও উনারা বলছিলেন, আসলেই পাওয়া যাবে, তারপরও রিস্ক নেই নাই। আর হ্যাঁ, ৩ তারিখে খাওয়ার পর কিন্তু সবাই প্রশংসাই করেছিলো বার্গারগুলোর, অসাধারণ ছিল সেই চিকেন বার্গারগুলো।
এবার রওনা হলাম গোয়াইনঘাটের দিকে। সেখানে গিয়ে খোঁজখবর করে জানা গেল নদীতে পানি একেবারেই নেই, পাথরের বাথান খটখটে হয়ে আছে, আর রাস্তা ভেঙ্গেচুরে একাকার। কি করা যায়? টুটুল ভাইকে বললাম, চলেন লোভাছড়া ঘুরে আসি। কানাইঘাট হয়ে গেলাম লোভাছড়া, সেখানেও হাঁটুপানি, তারপরও নৌকা চলে। সব দেখে, ঘুরে সিদ্ধান্ত নিলাম লালাখাল দেখে লোভাছড়া চলে আসবো, বিছানাকান্দি এবার বাদ যাবে। আমাদের মূল দলের প্রথম রাত থাকার প্ল্যান জৈন্তাপুর রিসোর্টে। পরেরদিন লালাখালে এবং লোভাছড়া। তাই একটা মিনিবাস ভাড়া করে ফেললাম, ২ তারিখ সকালে আমাদের রিসোর্ট হতে পিক করবে, লালাখাল-কানাইঘাট হয়ে লোভাছড়া ভ্রমণ শেষে আমাদের সিলেটে ‘হোটেল অনুরাগ’ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে, অর্থাৎ সারাদিনের জন্য রিজার্ভ। লোভাছড়ায় তিনটা নৌকাও ভাড়া করে এলাম।
তৃপ্ত মনে পরদিন ৩১ তারিখে জাফলং চলে এলাম, জৈন্তাপুর রিসোর্টে রুম কনফার্ম করার সাথে সকালের নাশতা ভুনা খিচুড়ি অর্ডার করে দিলাম। সারারাত ত্রিশ জন মানুষ জার্নি করে আসবে, তাই একটু ভালই হোক নাস্তাটা। রাতে হবে বারবিকিউ পার্টি, তার এরেঞ্জমেণ্ট এর প্রাথমিক কাজও সেরে রাখলাম ম্যানেজারের সাথে কথা বলে।
দুপুরে চলে গেলাম জাফলং, পিয়াইন নদীর হাঁটু পানি পেরিয়ে ওপারে ‘সংগ্রামপুঞ্জি রেস্তোরাঁয়’ ত্রিশ জনের লাঞ্চ অর্ডার করলাম। ডাউকি’র পাহাড় দেখতে দেখতে লাঞ্ছ করা, অসাম। ঐদিনের লাঞ্চটাও আমরা ঐখানে সেরে নিলাম। সাথে নদী পেরুনোর নৌকা, লাঞ্ছ শেষে খাসিয়া পল্লী, চা বাগান এগুলো ঘুরে দেখার জন্য সাতখানা ভ্যান-রিক্সা রিজার্ভ করে রাখলাম। এপারে ফিরে এসে জাফলং থেকে জৈন্তাপুর রিসোর্ট ফেরার জন্য তিনটা হিউম্যান হলার ভাড়া করে রাখলাম। সব কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন। আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভালো থাকার জায়গা খুঁজে খুঁজে গিয়ে উঠলাম ঐ উপজেলা পরিষদের পিয়াইন নদীর তীরের রেস্ট হাউজে। তখনও কি জানতাম এটা হবে আমাদের সবচেয়ে জঘন্ন একটা ট্যুর!
সারারাত ঘুমাতে পারলাম না সেই রেস্ট হাউজে। নদীর তীরে রেস্টহাউজ, ভেবেছিলাম জানালা খুলে দিলে হু হু করে আসবে বাতাস... কোথায় কি? একফোঁটা বাতাসের নামগন্ধ ছিলো না। সাথে উপদ্রব হিসেবে ছিলো কালো রঙের ইয়া বড় বড় এক রকম পোকা। সারারাতে মনে শ'দুয়েক মেরেছিলাম। টুটুল ভাই একসময় রেস্ট হাউজের বারান্দায় গিয়ে গামছা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আর আমার মনে হচ্ছিলো মাথার চুল টেনে টেনে ছিড়ে ফেলি। টুটূল ভাই আছে আরামে, তার সাথে এই রেকি করতে আইসা আমি আছি ঝামেলায়। সবকিছু আমায় করতে হচ্ছে, উনি শুধু অর্ডার দিচ্ছে। এমনকি কোন তথ্য বা ফোন নাম্বার লিখতেও আমাকে হুকুম!!! শেষে আমি বললাম, "ভাই এই লেখালেখি'র কাজটা অন্তত আপনে সারেন..."। আমি তাকে দেখে ইর্ষা করলাম, কি আরামে বারান্দার ফ্লোরে এই গরমে ঘুমিয়ে গেছে। আর এদিকে আমার গতরাতে বাস জার্নিতে ঘুম হয় নাই, আজও যদি না ঘুমাতে পারি তবে চলবে কিভাবে?
যাই হোক এই করে করে সারারাত পার করে দিলাম। ভোর পাঁচটা নাগাদ, ফোনে রবিউল হাসান খান মনা জানালো তাদের বাস এখন টঙ্গীতে। ঘটনা কিছুই বুঝলাম না, ঢাকা থেকে আসবে সিলেট, টঙ্গীতে গাড়ী কি করে? সেই রাত দশটায় গাড়ী ছেড়েছে ঢাকা থেকে, এতক্ষনে সিলেটের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার কথা। মনা’র আবার গাড়ীতে ভালো ঘুম হয়, ভাবলাম ঘুমের ঘোরে আবোল-তাবোল বকছে। লাইন কেটে দিয়ে তাহসিন’কে ফোন দিলাম। “কোথায় এখন আপনারা?” জিজ্ঞাসা করতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো, ‘টঙ্গী’!!!!...। মানে কি? হালকা যা...ও... ঘুমের রেশ চোখে ছিল সব নিমিষে উধাও।
ভ্রমণকালঃ ৩০ এপ্রিল, ২০১৪
মন্তব্যসমূহ