ভোর পাঁচটা, ফোনে রবিউল হাসান খান মনা জানালো তাদের বাস এখন টঙ্গীতে। ঘটনা কিছুই বুঝলাম না, ঢাকা থেকে আসবে সিলেট, টঙ্গীতে গাড়ী কি করে? সেই রাত দশটায় গাড়ী ছেড়েছে ঢাকা থেকে, এতক্ষনে সিলেটের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার কথা। মনা’র আবার গাড়ীতে ভালো ঘুম হয়, ভাবলাম ঘুমের ঘোরে আবোল-তাবোল বকছে। লাইন কেটে দিয়ে তাহসিন’কে ফোন দিলাম। “কোথায় এখন আপনারা?” জিজ্ঞাসা করতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো, ‘টঙ্গী’!!!!...। মানে কি?
তাহসিন যা জানালো, তার সারমর্ম কাল রাতে শীতলক্ষ্যা নদীতে গুম হওয়া ছয়জনের লাশ উদ্ধার হয়, এই নিয়ে চলে ব্যাপক ভাংচুর, রাস্তা বন্ধ করে দেয়। শেষে রাত বারোটার দিকে গাড়ী ঘুরিয়ে টঙ্গী হয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সারারাত গাড়ী জ্যামে টঙ্গীতেই আটকে আছে। এক কাপল রাত দুইটার দিকে বাস হতে নেমে বাসায় চলে গেছে। গাড়ী কখন সিলেট পৌঁছবে কেউ জানে না।
গাড়ী বুকিং করা হয়েছিলো আহমদ পরিবহণের; ঢাকা থেকে সরাসরি জাফলং পর্যন্ত একমাত্র এদেরই বাস যায়। আর তাই ইউনিক, শ্যামলী'র ভালো ভালো অপশন থাকা সত্ত্বেও বুক করা হয়েছিলো এই আহমদ পরিবহণের বাস। বাসে ছিলো চার বছরের ছোট্ট শিশু থেকে ষাট বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। বাস যখন সারারাত তীব্র গরমে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, তখন বাসের ব্যাটারি কাজ করছিলো না, ফলে সবকয়টা পাখা ছিলো বন্ধ। চিন্তা করা যায়? ৩৪-৩৬ ডিগ্রী গরমে প্রায় ২০ ঘন্টার উপরে সবাই কষ্ট করেছে। এর মাঝে চারজন রাত দুটো তিনটে'র দিকে বাস থেকে নেমে বাসায় চলে গেল।
যাই হোক, প্রি এরেঞ্জমেন্ট করতে আসা আমরা দুজন পড়লাম মাইনকার চিপায়। প্রথমেই সকালের নাস্তা ক্যান্সেল করার জন্য জৈন্তাহিল রিসোর্টে ফোন করে জানলাম, নাস্তার খিচুড়ি চুলোয় চড়াচ্ছে, সেটা অনেক বুঝিয়ে থামালাম। এরপর একে একে সব জায়গায় ফোন দিয়ে দিয়ে খাবার অর্ডার কোথাও ক্যান্সেল, কোথাও স্টপ; পরিবহনগুলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যাবস্থা নিতে হল।
এর মধ্যে ঝামেলায় ছিলাম সংগ্রামপুঞ্জি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ নিয়ে। মনা একবার বললো লাঞ্চ ক্যান্সেল করতে, ক্যান্সেল করালাম ফোনে। আবার ফোন দিয়ে জানালো জ্যাম ছুটে গেছে, দুপুরের দিকে তাঁরা সিলেট থাকবে ইনশাআল্লাহ, আবার ফোন করে সংগ্রামপুঞ্জিতে। এবার আমি আর টুটুল ভাই সরাসরি সেখানে গেলাম। আবার অর্ডার কনফার্ম করার কিছুক্ষণ পর মনা ফোন দিয়ে বললো, "এক কাজ কর রে, লাঞ্চটা ক্যান্সেল করে দে..."। মেজাজটা কেমন লাগে। শেষে টুটুল ভাই সিদ্ধান্ত দিলো, যত দেরী হোক, সবাইকে নিয়ে সরাসরি জাফলং চলে যাবো আমরা। সেখানে আশপাশটা ঘুরে সংগ্রামপুঞ্জিতে লেট লাঞ্চ সেরে পরে আমরা ফিরে আসবো জৈন্তাহিল রিসোর্টে।
এরপর আমি আর টুটুল ভাই সকালনের নাস্তা সেরে জাফলং এর উপজেলা পরিষদ এর রেস্ট হাউজ হতে চেক আউট করে চলে এলাম জৈন্তাহিল। এখানে এসে টুটুল ভাই রাতের বারবিকিউ এর আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর আমি ফোনে ফোনে খবর নিতে লাগলাম দলের সবাইকে নিয়ে বাস কতদূর পৌছলো। শেষ বিকেলের আগে আগে বাস জৈন্তা হিল রিসোর্টে কাছে আসলে পরে আমরা তাদের নিয়ে চলে গেলাম সরাসরি জাফলং।
জাফলং এসে নদী পারাপারে বাঁধলো বিপত্তি। গতকাল থেকে আমি আর টুটুল ভাই সংগ্রামপুঞ্জি যেতে আসতে প্রতিবার জনপ্রতি ০৫ টাকা করে লোকাল নৌকায় পারাপার হয়েছি। আমাদের বিশাল দল দেখে ঘাটের লোকজন সিন্ডিকেট করলো। পুরো দলের পারাপের জন্য জনপ্রতি প্রায় একশত টাকা করে চেয়ে বসে থাকলো। আমি আগে থেকে আমার বুক করে রাখা নৌকার মাঝিকে ফোন দিলে সে জানালো আমাদের দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু ভয়ে দূরে আছে। তাকে কাছে আসতে বললে, সে নৌকা নিয়ে ঘাটে আসলো। ঘাটের লোকজন সেই নৌকায় আমাদের চড়তে দিলো না, বরং আমাদের বুক করে রাখা নৌকার মাঝিকে মারধর করে তাড়িয়ে দিলো। অনেক বাকবিতন্ডার পর টুটুল ভাইয়ের পরামর্শে আঠারশত টাকায় ৩২ জনের দল নদী পারাপার হলাম। অথচ লোকাল রেটে ভাড়া হয় সর্বোচ্চ তিন থেকে চারশত টাকা।
সন্ধ্যের ঠিক আগ মুহুর্তে দলের সবাই সংগ্রামপুঞ্জি পৌঁছলে পরে চারিদিকে ঘোরাঘুরি এবং লেট লাঞ্চ সারতে সারতে প্রায় রাত সাতটা বেজে গেল আমাদের জৈন্তা হিলে ব্যাক করতে করতে।
মন্তব্যসমূহ