স্বপ্নের ‘সাজেক ভ্যালী’ (তিন দিনে তিন পার্বত্যজেলা ভ্রমণ – পর্ব ০১)

#

গল্পের ছবিসকল

  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
  • সাজেক ভ্যালী
গত তিনদিন ভোর হয়েছে পাহাড়ের ফাঁকে সূর্য উদয় দেখে, দুপুর কেটেছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে ইঞ্চিন চালিত বাহনে ছুটে ছুটে। বিকেলে দেখেছি পাহাড়ি মিষ্টি বাতাসের হুটোপুটি। সন্ধ্যায় আকাশের বুকে লাজুক সূর্যটার লজ্জায় লাল হয়ে হাড়িয়ে যাওয়া। দিনভর পাহাড় আর পাহাড়ের রূপ দেখে তন্ময় হয়ে থাকা। এই অলস দুপুরে খুব অবাক লাগছে নিজের চার দেয়ালে ঘেরা ঘরটাকে। গত তিনদিন কি স্বপ্ন ছিল, নাকি আজ স্বপ্ন দেখছি, কোন ভুল স্বপ্ন। এমন তিনদিন যেন জীবনে বারে বারে আসে। 
আমার মত প্রায় একশত কিলোগ্রাম ওজনের মানুষ ব্যাকপেইন নিয়ে তিন দিনে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-বাঘাইছড়ী হয়ে স্বপ্নের সাজেক ভ্যালী, সিএনজি করে ঝড়ো হাওয়ার মাঝে খাগড়াছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি যাওয়া, রাঙ্গামাটির পর্যটন মোটেলে কাপ্তাই লেকের পারে রাত্রিযাপন, ঊষা লগ্নে দূর পাহাড়ের বুক চিরে কাপ্তাই এর জলে রক্তিম ছায়া ফেলে সূর্যোদয়, সকাল থেকে দুপুর অবধি কাপ্তাই লেক জুড়ে বড় একটি নৌকা নিয়ে চার জনের আমাদের ছোট্ট দলের ঘুরে বেড়ানো, বান্দরবানে রাত্রি কাটিয়ে পরদিন চারজন পুরো একটি জীপ রিজার্ভ করে শৈলপ্রপাত, চিম্বুক পাহাড়, পিক-সিক্সটিনাইন, স্বপ্নের নীলগিরি, জাদিপাই স্বর্ণ মন্দির দেখে শেষ বিকেলের আলোয় নীলাচলের উপরে তন্ময় হয়ে বসে থাকা শেষ আলোটুকু নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। 
ঘটনার শুরু সপ্তাহ দুয়েক আগে। আমার এক্স কলিগ রুমি ভাই ফোন করে বললেন যে, সামনের ১৫-১৭ তারিখ তার ছুটি রয়েছে। তাই উনি এই ছুটিতে রাঙ্গামাটি ঘুরে আসতে চান। আমি যেন একটু খোঁজ খবর করে উনাকে ট্যুর প্ল্যান করে দেই। আমিও ঐ সময়টায় ফ্রি থাকাতে উনাকে বললাম যে, আমাকেও নিয়ে যান। যেই কথা, সেই কাজ। উনি আমাকে ট্যুর প্ল্যান করতে দায়িত্ব দিলেন। আমি এর ওর কাছে থেকে ইনফরমেশন নিচ্ছি কি কি দেখা যায়, কোথায় থাকা বেটার ইত্যাদি বিষয়ে। তো দিন দুয়েক পর রুমি ভাই ফোন করে জানালেন যে, উনি অবশ্যই ‘সাজেক ভ্যালী’ যেতে চান। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ‘সাজেক ভ্যালী’ রাঙ্গামাটি জেলার অন্তর্গত হলেও যেতে হবে খাগড়াছড়ি দিয়ে। অভিজ্ঞ ট্রাকার তাহসিন মামাকে জিজ্ঞাসা করতে উনি একটি ভালো প্ল্যান দিলেন। বললেন আপনারা খাগড়াছড়ি হতে মারিশা হয়ে বোটে করে রাঙ্গামাটি চলে যান। আর মারিশা যাওয়ার আগের দিন ‘সাজেক ভ্যালী’ দেখে যাবেন। 
প্রস্তাব পছন্দ হল, রুমিকে জানালাম; ঐদিকে উনি আরও দুইজন ম্যানেজ করে ফেলেছেন। আমরা মোট চারজনের দল। আমি খোঁজ নেয়া শুরু করলাম ‘সাজেক ভ্যালী’ যাওয়ার রাস্তা, সেখানে রাত্রি যাপন, মারিশা যাওয়া এবং রাত্রি যাপন, সেখান থেকে রাঙ্গামাটি যাওয়ার বোট ট্রিপ ইত্যাদি বিষয়ে। কিন্তু যাওয়ার দিন পর্যন্ত আমি কোন মনপুত তথ্য যোগাড় করতে পারলাম না। আমি আগে ঐ এলাকায় কখনো যাইনি। গত মাসে আমি এবং রুমি দুজনই ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ এর সাথে সাঙরাই উৎসব দেখতে পহেলা বৈশাখ কাটিয়েছি খাগড়াছড়িতে, কিন্তু সেটা ছিল খাগড়াছড়ি শহরে। কি আর করা, আল্লাহর নাম নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রচুর জার্নি করতে হবে ভেবে ‘সেন্টমার্টিন পরিবহণ’ এর ইকনোমিক ক্লাসের এসি বাসের টিকেট কাটলাম খাগড়াছড়ি পর্যন্ত। বুধবার রাত এগারোটার গাড়ীতে রওনা হলাম খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে। 
পরদিন সকাল সাতটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম খাগড়াছড়ি শহরে। যতটুকু খোঁজ নিয়ে এসেছি এখান থেকে আমাদের ধরতে হবে শান্তি পরিবহণের গাড়ী। সাজেক গেলে পরে নামতে হবে বোয়ালছড়ি, আর মারিশা গেলে লংদু। নেমেই ছুট লাগালাম শান্তি পরিবহণের কাউণ্টারে। কিন্তু একি! সেখানে গিয়ে শুনি কোন সিট ফাঁকা নেই এবং আর কোন পেসেঞ্জারও তারা নিবে না, আর পরের গাড়ী কখন আসবে কিছুই বলল না। শুরুতেই পড়লাম মহা বিপদে। এদিক সেদিক খুঁজতে খুঁজতে দেখি কিছু ‘চান্দের গাড়ী’ দাঁড়িয়ে আছে কিছু দূরে। তাদের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। সাজেক যেতে চাই, যাওয়া যাবে কি না? ভাড়া কত? ওমা! ভাড়া শুনে দমে গেলাম। পনের হাজার টাকা! কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে একজন রাজী হল বার হাজার টাকায়। কিন্তু চারজন মানুষের পক্ষে বার হাজার টাকা অনেক। হতাশ হয়ে বসে পড়লাম, কি করা যায় ভেবে নেই। 
হঠাৎ সামনে দিয়ে দেখি এক সিএনজি অটোরিকশা যেতে দেখে থামালাম। ড্রাইভার গাড়ী সাইড করতে তাকে বুঝিয়ে বললাম আমাদের সমস্যা আর সিএনজি অটোরিকশা করে যাওয়া যায় কি না তাও জিজ্ঞাসা করলাম। উনি বললেন ঐ রাস্তায় সহজে সিএনজি অটোরিকশা যায় না। তবে ভাল ইঞ্জিনের সিএনজি অটোরিকশা হলে এবং ভালো ড্রাইভার পেলে যাওয়া যাবে। উনাকে বলতে উনি বললেন উনার গাড়ী নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। উনাকে রিকোয়েস্ট করলাম একটা গাড়ী যোগাড় করে দিতে। উনি কয়েকজনকে ফোন করে যখন ব্যর্থ হলেন, তখন আমাদের উনার গাড়ীতে তুলে নিয়ে উনাদের স্ট্যান্ডে ছোট কামাল নামের এক ড্রাইভারকে নিয়ে আসলেন। বয়স বিশেকের এই ছেলেটি রাজী হল, ভাড়াও বেশী নয়, আমাদের নাগালেই। আমরা তার গাড়ীতে করে ছুটে চললাম সাজেকের উদ্দেশ্যে।
দীঘিনালা’র বোয়ালখালি এসে আমাদের সিএনজি অটোরিকশা থামলো। এটা মূলত একটা বাজার এলাকা। এখান থেকে সিএনজি অটোরিকশায় পর্যাপ্ত তেল ভরে নিল, আমরাও পার্শ্ববর্তী এক বাজারে গিয়ে মুখহাত ধুয়ে কিছু শুকনো খাবার কিনে নিলাম। প্রায় সত্তর কিলোমিটারের জার্নি শেষে স্বপ্নের ‘সাজেক ভ্যালী’। আপ ডাউন মিলে প্রায় দেড়শত কিলোমিটার। মিনিট বিশেকের বিরতি শেষে আমরা আবার ছুটে চললাম সাজেকের উদ্দেশ্যে। খাগড়াছড়ি শহর হতে ১৭ কিলোমিটার যাওয়ার পর ‘দীঘিনালা বনবিহার’ পার হলে রাস্তা দুদিকে গেছে। ডানের রাস্তা গেছে লংদু, যা সেখান হতে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার, এই লংদু হতেই আমাদের মারিশা যাওয়ার প্ল্যান। আর বামের রাস্তা বাঘাইছড়ি হয়ে চলে গেছে সাজেকের দিকে। 
আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ, পাহাড়ি ঢাল, কখনো প্রায় ষাট ডিগ্রি খাড়া ঢাল বেয়ে ছুটে চলল আমাদের এই যাত্রা, ছোট্ট একটি সিএনজি অটোরিকশা করে যার চালক বছর বিশেকের এক সদ্য যুবা। পথে তিন জায়গায় আমাদের রিপোর্ট করতে হল। প্রথমে বাঘাইহাট পুলিশ ক্যাম্পে, পরে বাঘাইছড়ি এবং মাসালাং রেঞ্জের আর্মি ক্যাম্পে। তিন জায়গাতেই আমাদের সবার পরিচয়, গাড়ী নাম্বার, ড্রাইভারের নাম, মোবাইল নাম্বার, আমাদের মোবাইল নাম্বার সহ কে কি করি, কোথায় থাকি, কেন এসেছি সব নোট করে রাখা হল। প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে বাঘাইছড়ি রেঞ্জের দায়িত্বরত আর্মি অফিসারের কাছ থেকে ঘটনা জানলাম। সাজেকের এই পথেই কিছুদিন আগে ‘টেলিটক’র চার কর্মকর্তা অপহরণ হয়েছিলেন। এলাকাটা ভালো না, বছর দশেক আগেও এখানে আর্মি সাধারণ পর্যটকদের নাকি সহজে ঢুকতে দিত না। এখনো পর্যটকদের অনেক কড়াকড়ি বিধিনিষেধ রয়েছে।
যাই হোক আমরা উনার কাছ থেকে কিছু পরামর্শ পেলাম যা যে কোন পর্যটকের সাজেক ভ্যালী ভ্রমণে মেনে চলা উচিত। বাঘাইছড়ি পার হওয়ার আগেই আপনার প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং পানীয় কিনে নিন। পথে কোন পাহাড়ি বাজার বা দোকানতো বটেই কোন বাড়ীতেও গাড়ী থামিয়ে খাদ্য বা পানি নিতে যাবেন না। হ্যাঁ, সকল পাহাড়ি লোকজন নিশ্চই খারাপ নয়, তবে সাবধান হতে দোষ কি? এটা আমার কথা নয়, দায়িত্বরত আর্মি অফিসারের কথা। দ্বিতীয়ত সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ফেরত আসুন এবং ফেরার সময় প্রতিটি চেক পোষ্টে আপনার প্রত্যাবর্তন রিপোর্ট করুন। 
পাহাড়ে আদিবাসীদের জীবন-আচার, পোশাক ইত্যাদি নিয়ে কোন মন্তব্য বা ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিবেন না। এমন কি অনেক জায়গায় সাধারণ হাসিও নয়! জী এমনটিই সত্য। সাজেক ভ্যালী’র পেছনে পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে ছোট্ট একটি গ্রাম, পাঁচ-সাতটি ঘর মাত্র। সেখানে দেখা মিলবে ‘টপলেস’ পোশাক পরিহিত উপজাতি জনগোষ্ঠী’র। আমাদের চেক পোষ্টেই এটা জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর যদি কোন কারনে তাদের সাথে আপনার দেখা হয়েই যায় তবে আপনি নরমাল বিহেভ করেন। কোনমতেই হেসে দিবেন না, ওরা হাসিটাকে খুব খারাপ চোখে দেখবে, এবং উত্তেজিত হয়ে আপনার উপর আক্রমণাত্মক হতে পারে। 
কিছু জায়গায় রাস্তা এত খাড়া ছিল যে, আমাদের সেই রাস্তাটুকু নেমে গিয়ে হেঁটে হেঁটে পার হতে হয়েছে, আর ড্রাইভার তার সিএনজি অটোরিকশা ফুল গিয়ার চেপে কোনমতে উঠে গিয়েছে। আমাদেরতো সিএনজি অটোরিকশা, আর্মি’র হেভি জীপগুলো পর্যন্ত উঠতে বেকায়দায় পড়তে দেখেছি। যাই হোক প্রায় ঘণ্টা তিনেকের চরাই-উৎরাই পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম স্বপ্নের ‘সাজেক ভ্যালী’তে। এখানে পৌঁছে শুধু একটি কথাই আপনার মুখ দিয়ে বের হবে, ‘ওয়াও!!!’ সেখানে গিয়ে ভালো একটা ক্যামেরা খুব মিস করেছি। আমার ক্ষুদ্র ক্যামেরায় যা পেয়েছি, তা উপরেরে ছবি স্লাইডে দিয়ে গেলাম। 

ভ্রমণকালঃ ১৫ মে, ২০১৪

পরের পর্ব

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ